বরাদ্দের চাল না পেয়ে ধারদেনা করে চলছে বনজীবীদের দিন

সুন্দরবনে প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেদের নৌকাগুলো বেঁধে রাখা হয়েছে লোকালয়ের কাছে। খুলনার কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর তীরে
ছবি: প্রথম আলো

বন্য প্রাণী এবং নদী-খালের মাছের বিচরণ ও প্রজনন কার্যক্রমের সুরক্ষায় গত ১ জুন থেকে তিন মাসের জন্য বন্ধ হয়েছে সুন্দরবনের দুয়ার। এ সময় পর্যটক প্রবেশসহ সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ও কাঁকড়া ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। চলতি নিষেধাজ্ঞার সময় খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বনের ওপর নির্ভরশীল সাড়ে চার হাজার জেলে পরিবারের দিন কাটছে অভাব-অনটনে। বন্ধের তিন মাস এসব কর্মহীন বনজীবীদের সরকারি সহায়তার আওতায় মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো সম্ভব হয়নি।

খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামগুলোয় গিয়ে দেখা গেছে, বেকার হয়ে পড়া জেলেদের সংসার চলছে ধারদেনায়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সংসারের ভরণপোষণ বহন করছেন তাঁরা। আবার অনেকে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। এসব পরিবারের সদস্যরা সাধারণত সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালে মাছ, কাঁকড়া এবং সুন্দরবন থেকে বনজ সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম দিকে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলেদের তালিকা চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৪ হাজার ৫০৮ জন জেলের তালিকা পাঠানো হয়। এসব জেলেদের পরিবারপ্রতি খাদ্যসহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

শুনেছিলাম বন্ধের সময় আমাদের মাসে ৪০ কেজি চাল দেওয়া হবে। দেড় মাসের বেশি হয়ে গেলেও চাল পাইনি আমরা। কখন পাব, তাও ঠিকঠাক জানি না।
ভৃতি মণ্ডল, বনজীবী

কয়রা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক বলেন, এ বছরই প্রথমবারের মতো সুন্দরবনের বন্ধ মৌসুমে কর্মহীন হয়ে পড়া বনজীবীদের খাদ্যসহায়তার উদ্যোগ নেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী প্রকৃত জেলেদের তালিকাও পাঠানো হয়েছে, তবে তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দ আসেনি। আশা করা হচ্ছে, আগস্টের মধ্যে তা পাওয়া যাবে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কয়রার বানিয়াখালী, কাশিয়াবাদ, কোবাদক ফরেস্ট স্টেশনসহ খুলনা রেঞ্জের আওতায় ২ হাজার ৯০০টি নৌকার সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) রয়েছে।

স্থানীয় বনজীবীরা বলছেন, কয়রায় বনজীবী জেলেদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে, কয়রা সদরের কিছু অংশ, মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন ভৌগোলিক কারণেই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষ-অধ্যুষিত। এসব এলাকায় অন্তত ১৫ হাজার জেলে পরিবারের বসবাস, যারা বংশপরম্পরায় বনজীবী। তারা সারা বছর সুন্দরবনসংলগ্ন নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান ও সরকারি সহায়তা না থাকায় বন্ধের এই মৌসুমে মানবেতর জীবন যাপন করছে বনজীবী পরিবারগুলো।

মহাজনের কাছ থেকে ধার করে সংসার চালাচ্ছি। যখন আবার সুন্দরবনে যেতে পারব, তখন সেই টাকা পরিশোধ করব।
আবু মুসা, বনজীবী

নিজেদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার পাথরখালী গ্রামের বনজীবী ময়জুদ্দিন মোড়ল বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া ধরেই আমাদের সংসার চলে। এখন সুন্দরবনে পাস বন্ধ। ডাঙায়ও কাজ নেই। বেকার বসে আছি। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছি না। বনজীবী পরিবারগুলোকে সরকারি সহায়তা দেওয়া না হলে কষ্টের শেষ হবে না।’

কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বানিয়াখালী গ্রামের বনজীবী জেলে ভৃতি মণ্ডল বলেন, ‘আমি নিয়মিত সুন্দরবনে যাই। কোনো মৌসুমে কাঁকড়া, কখনো মাছ, কখনো মধু সংগ্রহ করি। সাত দিন বনে থাকতে পারলে সব খরচ বাদ দিয়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এখন সুন্দরবনে ঢোকা বন্ধ করে দেওয়ায় চরম আর্থিক কষ্টে পড়েছি। শুনেছিলাম বন্ধের সময় আমাদের মাসে ৪০ কেজি চাল দেওয়া হবে। দেড় মাসের বেশি হয়ে গেলেও চাল পাইনি আমরা। কখন পাব, তাও ঠিকঠাক জানি না। কেউ ধারও দিতে চাচ্ছে না। কীভাবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কাটবে, তা বুঝতে পারছি না।’

সুন্দরবনসংলগ্ন মঠবাড়ি গ্রামের বনজীবী মৌয়াল আবু মুসা বলেন, ‘আমি ২২ বছর ধরে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করি। প্রতিবছর তিন মাস মধু সংগ্রহের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। তবে এ বছর দুই মাস না যেতেই সুন্দরবনে ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে। এখন বাড়িতেই বসে আছি। মহাজনের কাছ থেকে ধার করে সংসার চালাচ্ছি। যখন আবার সুন্দরবনে যেতে পারব, তখন সেই টাকা পরিশোধ করব।’

বনজীবীদের সরকারিভাবে সহায়তার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। কবে নাগাদ চালের বরাদ্দ আসবে, তা জানি না।
এ জেড এম হাসানুর রহমান, সহকারী বন সংরক্ষক, সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জ

সুন্দরবনসংলগ্ন দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছেন আলী মোড়ল বলেন, এলাকায় প্রায় দুই হাজার পরিবার আছে, যারা সরাসরি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বনে ঢোকা বন্ধ থাকায় এসব পরিবারের দিন কাটছে কষ্টে। যারা ভিজিডি ও ভিজিএফ পায়, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও অনেকেই এ সুবিধা পায় না। সেসব পরিবার চলছে ধারদেনায়।

সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, খুলনা রেঞ্জের সবচেয়ে বেশি বনজীবী আছেন কয়রা উপজেলায়। ১ জুন থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় সুন্দরবনের বনজ সম্পদ আহরণের সঙ্গে জড়িত কেউই বর্তমানে বনে প্রবেশ করতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে বনজীবীরা কোনো সরকারি সহায়তা পাবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁদের সরকারিভাবে সহায়তার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বনজীবীদের একটি তালিকাও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। কবে নাগাদ চালের বরাদ্দ আসবে, তা তিনি বলতে পারেন না।