সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও বুক কাঁপে জমিলার
ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি সবই প্লাবিত। শহরে তখন চার থেকে ছয় ফুট পানি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি, ঝড়, বজ্রপাত। এমনই এক সময়ে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথে আটকা পড়েন এক প্রসূতি। প্রসব যন্ত্রণায় কাতর ওই প্রসূতিকে নেওয়া হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। সেখানে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন জমিলা বেগম (২৮)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি জেনে ওই নবজাতকের নাম রাখেন ‘প্লাবন’। সেই প্লাবনের বয়স এখন এক বছর।
প্লাবন হয়তো জানে না তার জন্মদিনের সেই দুঃসহ সময়ের কথা। সে এখন হাঁটে, দৌড়ায়, মায়ের সঙ্গে খেলে। কিন্তু জমিলা ও তাঁর স্বামী সুমন মিয়া বিভীষিকাময় সেই দিনের কথা কখনো ভুলতে পারবেন না। বুধবার বিকেলে জমিলা বলছিলেন, ‘যত দিন বাঁচমু, মনও থাকব। এখনো মনও অইলে বুক কাঁপে। মানুষে সাহায্য না করলে ত শেষ আছলাম। আর যেন ইলা বন্যা দেশও না অয়।’
সুনামগঞ্জে গত বছরের বন্যায় সরকারি হিসাবে কমবেশি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। মারা যান ১৫ জন। ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় ৫০ হাজার। মানুষের ঘরের আসবাব, গোলার ধান, মাছের খামার, গবাদিপশু—সব ভেসে যায়। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা হয় গত বছরের ১৬ জুন। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ১০০ বছরে সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী ও সমাজকর্মী এনাম আহমেদ বলছিলেন, ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজানের ঢল নামছিল কয়েক দিন ধরে। শহরে ঢলের পানি ঢোকে ১৬ জুন সকালে। সন্ধ্যা নামার আগেই পুরো শহর প্লাবিত হয়ে যায়। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে জেলা শহর। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত মাথায় নিয়ে হাজার হাজার মানুষ উঁচু ভবন, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন বাসিন্দারা। সারা দেশ থেকে চার দিন বিচ্ছিন্ন ছিল সুনামগঞ্জ।
শিশু প্লাবনের বাবা সুমন মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের সৈয়দপুর গ্রামে। তাঁর শ্বশুরবাড়ি জেলা শহরের মল্লিকপুর এলাকায়। অন্যের মাইক্রোবাস চালান তিনি। তাহসিন (৫) নামে তাঁর আরেকটি ছেলে আছে। বন্যার সময় জমিলা মল্লিকপুরে বাবার বাড়িতে ছিলেন।
কথা বলতে গিয়ে সুমন মিয়া এক বছর আগে ফিরে যান। তিনি বলেন, সেদিন ছিল শনিবার। সকাল হয়েছে। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় পানি। বৃষ্টি-বজ্রপাত হচ্ছে। ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। এর মধ্যেই জমিলার প্রসববেদনা ওঠে। একপর্যায়ে একটা ছোট নৌকা জোগাড় করে জমিলাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেন তিনি। রাস্তার ওপর দিয়ে নৌকা ঠেলে যাচ্ছেন। সড়কে বানভাসি মানুষের ছোটাছুটি। দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর পথে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মূল ফটকের সামনে গিয়ে নৌকাটি আটকে যায়।
সুমন মিয়া বলেন, জমিলার অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। তখন নিজের কার্যালয়ে ঢুকছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনিসহ কয়েকজন নৌকাটি ঠেলে তাঁর কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানেই জমিলার সন্তান প্রসব হয়। সন্ধ্যায় জেলার বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ নিতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন বিষয়টি জেনে প্রধানমন্ত্রী সন্তানের নাম রাখেন ‘প্লাবন’। একই সঙ্গে তাঁর পক্ষ থেকে প্লাবনকে বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দেন। তিনি সব সময় প্লাবনের খোঁজ রাখতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে আসার পর সিলেট সার্কিট হাউসেও প্লাবনের খোঁজ নেন। ভূমিহীন, গৃহহীন সুমন মিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি ঘর দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল তখন। তবে এখনো সেটি তিনি পাননি।
সুমন ও জমিলা জানান, তাঁরা ওই দিন যে সহযোগিতা পেয়েছেন, সেটি কখনো ভুলবেন না। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নাম নিয়ে ছেলে বড় হচ্ছে, এতে তাঁরা খুশি। তবে তাঁদের অবস্থা ভালো না। মাথা গোঁজাই ঠাঁই পেলে বড় উপকার হয় তাঁদের।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, তাঁরা ওই পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করেছেন। সুমনকে তাঁর স্থায়ী ঠিকানায় ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা সেখানে নেননি। এখন তাঁরা জেলা সদরে ঘর চান। জেলা প্রশাসন সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি জানান।
সুনামগঞ্জে গত বছরের বন্যায় সরকারি হিসাবে কমবেশি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। মারা যান ১৫ জন। ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় ৫০ হাজার। মানুষের ঘরের আসবাব, গোলার ধান, মাছের খামার, গবাদিপশু—সব ভেসে যায়। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
গতবারের বন্যার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘গত বছর যে বন্যা হয়েছে, সেটি অস্বাভাবিক। এখানে ছোট-বড় বন্যা হবেই। এতে মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে কম হয়, সেটি চিন্তায় রেখেই আমরা ভবিষ্যতে কাজ করব।’