স্বেচ্ছাশ্রম আর একতার বাঁধনে চলছে বাঁধের কাজ, বাড়ছে অপেক্ষা

জোয়ারের পানির চাপে ভদ্রা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ১৩টি গ্রাম। এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামে শনিবারছবি: সাদ্দাম হোসেন

প্রকৃতির নির্মম ছোবল, খাওয়ার পানির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম আর চরম দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকার এক দুরূহ সংগ্রামে লিপ্ত খুলনা উপকূলের প্রান্তিক মানুষ। টিকে থাকা এই সংগ্রামে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ উপকূলের বেড়িবাঁধ। কিছুদিন পরপর ভাঙা বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। আর স্বেচ্ছাশ্রমে তা ঠেকাতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে মানুষকে।

এবার খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে তিন দিন ধরে ভাঙা বাঁধের পানি আটকাতে অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার মানুষ। কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, নারী—সবাই আছেন সেই কাতারে। আশপাশের যাদের এলাকা সুরক্ষিত আছে সেখানকার শত শত মানুষও যোগ দিচ্ছেন বাঁধের কাজে। বারবার বিফলে যাচ্ছে চেষ্টা তবে দমে যাচ্ছেন না কেউ। নতুন উদ্যমে, নতুন উদ্যোগে আবারও একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন পানির স্রোত ঠেকানোর লড়াইয়ে।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর দুর্গম যোগাযোগ–ব্যবস্থার কারণে ভাঙন এলাকায় পৌঁছানোটা কঠিন পরীক্ষা। খুলনা শহর থেকে বটিয়াঘাটা পাইকগাছা সীমান্তের ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কপথে গিয়ে এরপর নৌপথে ট্রলার যোগে যেতে হয় কালীনগরে।

শনিবার ভাঙন এলাকায় পৌঁছে দেখা যায়, পানি আটকানোর চেষ্টায় কাজ করছেন শত শত মানুষ। কেউ কোদাল দিয়ে মাটি কাটছেন। সেই মাটি লম্বা সারি করে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের হাতে দিচ্ছেন। বাঁধের কাছে দাঁড়ানো কিছু মানুষ সেই মাটি দিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ সেগুলো মাটিতে পুঁতে পাইলিং করছেন। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে নারী-শিশুদেরও কাজ করতে দেখা গেল। অনেক নারী বাড়ি থেকে কলসে করে পানি এনে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা মানুষের তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন। মাইকে, হ্যান্ডমাইকে দেওয়া হচ্ছে নির্দেশনা।

এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে কাজে হাত লাগাচ্ছেন। একই সঙ্গে তাঁরা উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা, সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। খুলনা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ও অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সেখানে হাজির হচ্ছেন।

দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য চম্বক বিশ্বাস বলছিলেন, বৃহস্পতিবার ভদ্রা নদীর পাশে প্রায় ৩০০ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। তাতে ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ফসল ও কাঁচা ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে আমনের বীজতলা, চিংড়িঘের আর পুকুরের মাছ। হাজারো মানুষ বাঁশ ও মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে রিং বাঁধ নির্মাণের কাজ করছেন। এখনো পানির স্রোত ঠেকানো যায়নি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে দেখা গেল, আশপাশের উপজেলা ও ইউনিয়ন থেকে ট্রলারে করে শত শত মানুষ এসে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। দেলুটির পাশের সোলাদানা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হক কয়েক শ মানুষ নিয়ে কাজে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বাঁধ বাঁধলে সেগুলো টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তাই বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের বিফল চেষ্টা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে শনিবার নতুন কৌশলে সেখানে কাজ করছেন তাঁরা। শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ভাটা শুরুর পর নতুন উদ্যমে চলে বাঁধ বাঁধার কাজ। ধীরে হলেও একবারে মজবুত করে বাঁধতে বাঁধতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। শনিবার দুপুরে জোয়ার আসার আগ পর্যন্ত অর্ধেক অংশ ভালোভাবে বাঁধা হয়েছে। জোয়ারে ক্ষতি থেকে বাঁধ বাঁচানোর জন্য পলিথিন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কাল রোববার পুরোটা বেঁধে ফেলা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তাঁরা। জনবল ছাড়া পাউবো অন্য সহযোগিতা দিচ্ছে।

স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল। কাজের এক ফাঁকে তিনি বলেন, এলাকার সব জনপ্রতিনিধি এখানে আছেন। সবাই নিজেদের লোকজন নিয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে এখানে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে নেই। আশপাশের স্কুলগুলোতে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সবাই যাতে পায় সে জন্য এলাকায় ত্রাণ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

একপর্যায়ে আক্ষেপ ঝরে তাঁর কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘রিমালের সময় তিন মাস আগেও এখানকার ১৩টি গ্রাম ডুবে গিয়েছিল। সত্তরের দশকে নির্মিত দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে আমরা বারবার এভাবে ডুবে যেতে চাই না। আমাদের একটাই দাবি আমরা কোনো ত্রাণ চাই না, আমরা টেকসই বেড়িবাঁধ চাই।’

বেড়িবাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ থেকে কিছুটা দূরে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন কালীনগর গ্রামের  আনারতি মণ্ডল। কীভাবে তাঁর গবাদিপশুগুলো অন্য কোথাও আপাতত রাখা যায়, সে জন্য চিন্তিত তিনি। আনারতি বলেন, ‘আমাদের এখানে সবার প্রায় মাটির ঘর। কিছু নেই বললিই চলে। ঘের-টের সব ডুবে যাক, তাতে সমস্যানি। তবে যদি রান্না খাওয়া না করতি পারি কি কুরে বাঁচব। ত্রাণে কিছু মুড়ি চিড়া দেচ্ছে তা–ই খাচ্ছি। গরু কয়টা কোথায়ও পাঠানো যায় কি না, সেই চিন্তা করতিছি।’

ভাঙা জায়গা থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে সাধুর ঘাট এলাকায় খুলনা থেকে যাওয়া  শিক্ষার্থীদের একটি দল খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছিল। তাঁদের কাছ থেকে ওড়নার মাথায় মুড়ি নেন সৈয়দখালী গ্রামের খাদিজা বিবি, কোলে তাঁর চার বছর বয়সী শিশু মাঈশা আক্তার। খাদিজা বললেন, আগেও এলাকার বাঁধ ভেঙেছে। তবে এ রকম পরিস্থিতি হয়নি। মানুষের রান্না খাওয়াও বন্ধ। জানি না কবে এই দশা থেকে মুক্তি পাবেন! খাদিজা কথা বলা সময় আকাশে কালো মেঘ চারপাশ অন্ধকার করে ফেলে। এরপর মুষলধারে বৃষ্টি নামে।