রাজশাহী মহানগরে বাস্তবে পুকুর হয়ে যাচ্ছে প্লট

রাজশাহী নগরের বড় বনগ্রাম এলাকায় এভাবেই পুকুর ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। রোববার সন্ধ্যায় নগরের বড় বোন গ্রাম এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

পুকুরে এখনো টলমল করছে পানি। অথচ দুই বছর আগে কাগজপত্রে পুকুরটির শ্রেণি পরিবর্তিত হয়ে ‘ভিটা’ হয়ে গেছে। মালিক ভিটা হিসেবেই খাজনা পরিশোধ করেছেন। পুকুরটি রাজশাহী নগরের আরাজি শিরোইল মৌজার। এখন পুকুরটি ভরাটের চেষ্টা করছেন মালিক। রাজশাহীতে এভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে শ্রেণি পরিবর্তন করে একের পর এক পুকুর ভরাট করা হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুকুর ভরাটে জড়িত প্রভাবশালী একটি মহল। তারা সস্তায় পুকুর কিনে এভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করে ভরাটের পর চড়া দামে প্লট আকারে বিক্রি করছে। এই পুকুর ভরাটের সঙ্গে শাহমখদুম থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত আলী (শাহু) জড়িত আছেন। পলাতক থাকায় এই বিষয়ে চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে হলে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে হয়। প্রয়োজনীয় তদন্তের পর সংশ্লিষ্ট এলাকার এসি ল্যান্ডকে আদেশ দেন জেলা প্রশাসক। তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই পুকুরের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের কাছে কোনো আবেদনই করা হয়নি। জেলা প্রশাসকও কোনো আদেশ দেননি। শুধু নামজারির সময় পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করে ‘ভিটা’ করে দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, একইভাবে নগরের পোস্টাল একাডেমির উত্তর পাশের বড়বনগ্রাম মৌজার ৮২ নম্বর জেএলের ২০২৪ দাগের ১ একর ৬৩ শতাংশ আয়তনের একটি বড় পুকুর ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করা হয়েছে। এই দুটি পুকুরের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের ১৮টি প্রস্তাবিত খতিয়ান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ২০২৩ সালের ২৬ জুন বোয়ালিয়া এলাকার তৎকালীন এসি ল্যান্ড শাহীন মিয়া বড়বনগ্রাম মৌজার পুকুরের ১৬টি খতিয়ান সই করেন। এই পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করে ‘ধানি’ দেখানো হয়েছে। আর ১৪ জুন আরাজি শিরোইল মৌজার পুকুরের কিছু অংশের দুটি খতিয়ান সই করে অনুমোদন দিয়েছেন এসি ল্যান্ড শাহিন মিয়া। এসব জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে কোনো আবেদন করা হয়নি। তাঁর দাপ্তরিক কোনো আদেশও নেই।

নগরের বড়বনগ্রাম এলাকার পোস্টাল একাডেমির পাশের ১ একর ৬৩ শতাংশ আয়তনের পুকুরটি ভরাট করে তৈরি করা প্লটে ইতিমধ্যে বাড়িঘর নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৯টি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। তবে জায়গাটি যে পুকুর ছিল, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে। ভরাট করার পরও এলাকার সব পানি এসে ওই জায়গায় জমেছে। সেখানে প্লট মালিকদের একজনকে পাওয়া যায়। তাঁর নাম টিপু সুলতান। তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। ২০২২ সালে আড়াই কাঠা জমি কিনেছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাদাত হোসেনের কাছ থেকে তিনি এই জমি কিনেছেন। ভরাট করার পর সরেজমিন দেখেই তিনি কিনেছেন। এখন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। একতলা পর্যন্ত উঠেছে।

আরেকটি বাড়ির মালিকের নাম যোগেশচন্দ্র প্রামাণিক । তিনি প্রায় দেড় কাঠা জমি কিনেছেন। ইতিমধ্যেই তিনতলা পর্যন্ত ভবন উঠে গেছে। ভবনের পাশেই তাঁর স্ত্রীকে পাওয়া গেল। তিনি জানান, তাঁদের বাড়ি বাগমারা উপজেলায়। তাঁর স্বামী বেসরকারি সংস্থা আশায় চাকরি করেন। তাঁরা এখানে দেড় কাঠা জমি কিনেছেন।

যাঁরা জমি কিনেছেন, তাঁরা জানান, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও শাহমখদুম থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত আলী পুকুরটি কিনে ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করেছেন। বর্তমানে তিনি পলাতক। এ জন্য তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নগরের আহম্মদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে আরাজি শিরোইল মৌজার পুকুরটির আরএস খতিয়ান নম্বর ৪৪, জেএল নম্বর ১১, শ্রেণি পুকুর, যা বহুকাল ধরে ‘মেহেরের পুকুর’ নামে পরিচিত। ২০২২ সালের মার্চে পুকুরটির অংশবিশেষ মূল মালিকের থেকে কিনে নেন নগরের রানীনগর এলাকার মো. শহিদুল ইসলাম ও তালাইমারী এলাকার তৌফিক হাসান। এরপর গত বছরের ৫ জুন বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়ে পুকুরটির রকম বদলে ভিটা (আবাসিক) করে ফেলা হয়। এখানে শহীদুলের জমির পরিমাণ ৯ দশমিক শূন্য ৫৫ শতাংশ। তৌফিক হাসানের জমির পরিমাণ শূন্য ৮০৬ শতাংশ।

গত ২৫ আগস্ট ওই পুকুরের ভরাট বন্ধের দাবিতে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একটি আবেদন করেন এলাকাবাসী। আবেদনে তাঁরা পুকুর ভরাট ও জমির শ্রেণি জালিয়াতির অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, রাজশাহী নগরে পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের চার দফা নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। আরাজি শিরোইল মৌজার পুকুরটি আহম্মদপুর, সেখেরচক, বাজে কাজলা, পঞ্চবটি এলাকার মানুষ ব্যবহার করেন। বিশেষ করে পাশের নদী রক্ষা বাঁধের ওপারের বাসিন্দারা পদ্মা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পুকুরটির পানি ব্যবহার করেন। ২০২০ সালের মার্চে একবার রাতারাতি বালু দিয়ে ভরাটের তৎপরতা চালালে এলাকাবাসী ও পুলিশের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশন, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে লিখিতভাবে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত ১৩ আগস্ট পুলিশ প্রশাসনের এলোমেলো থাকার সুযোগে আবার ভরাটের তৎপরতা শুরু হয়। পুকুরের মাঝবরাবর টিনের বেড়া দেয়। বিষয়টি সেনাবাহিনীর নজরে আনলে ভরাটকারীরা পালিয়ে যায়। কিন্তু তারা এখনো তৎপর।

গত মঙ্গলবার পুকুরের কাছে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শ্রমিক পুকুরের মাঝবরাবর বেড়া দেওয়ার কাজ করছেন। কী জন্য বেড়া দেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে শ্রমিকেরা জানান, বেড়া দিয়ে একাংশ ভরাট করে ভাঙারির দোকান করা হবে। এ বিষয়ে পুকুরের একাংশের মালিক শহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।

মেহেরের পুকুরসহ পোস্টাল একাডেমির পাশের পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তনের সব কটি খতিয়ানে স্বাক্ষর করেন বোয়ালিয়া এলাকার তৎকালীন এসি ল্যান্ড শাহীন মিয়া। বর্তমানে তিনি রাজশাহীর জুডিশিয়াল মুন্সিখানায় জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে শাহীন মিয়া বলেন, নায়েব সাহেব (সহকারী ভূমি কর্মকর্তা) যেভাবে প্রস্তাব করেছেন, সেভাবেই খতিয়ান অনুমোদন করা হয়েছে। এটা তাঁর আরও যাচাইয়ের দরকার ছিল। এখন অনলাইনে কাজ হয়। অনেক কাজের ভিড়ে হয়তো দেখা সম্ভব হয়নি। ১৮টি খতিয়ানে এমন ভুল হতে পারে কি না, প্রশ্ন করলে শাহীন মিয়া বলেন, ‘এটা অসাবধানতাবশত করণিক ভুল হতে পারে অথবা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নথি উপস্থাপন করা হয়েছে কি না, দেখতে হবে। আগামী রোববার বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারব।’

জানতে চাইলে রাজশাহীর ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক সরকার অসীম কুমার প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া এভাবে কেউ ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারেন না। খতিয়ানগুলো পেলে দেখে তিনি বলতে পারবেন, আসলে কী হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।