সময়টা এখন হেমন্তেরই, সোনালি ফসলের। নীল আকাশে মাঝেমধে৵ সাদা মেঘ ভেসে বেড়ালেও বৃষ্টি নেই, সোনার ধানের গন্ধমাখা হাওয়া হেমন্তের প্রকৃতিতে। প্যাঁচার ধূসর ডানার মতো একটু একটু করে কুয়াশার রঙে পালক খুলছে শীত। সকালে কুয়াশা আহ্লাদে জড়িয়ে থাকছে সবকিছু।
শীত যে পড়শি এখন—তারই আভাস হয়ে ঘাসে, কলাপাতায়, গাছে গাছে সেই কুয়াশা শিশির হয়ে জমছে। রোদ বাড়লে শিশিরের জলফোঁটা ধুলার শরীরে কিছুটা দাগ রেখে উবে যায়, কুয়াশা হারিয়ে যায়, হেমন্ত এরকমই।
হেমন্তের এই একটা সময়ে মাঠের দিকে যতদূর তাকানো যায়, চোখে পড়ে সোনালি ধান শুয়ে আছে খেতে। মাঠ থেকে এখন চোখ ফেরানো যায় না। যেন এই একটা সময়ে আর কোনো কথা নেই, আর কোনো গান নেই। ‘ধানের রসের গল্প পৃথিবীর—পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ’ ‘সিন্ধুসারসে’ জীবনানন্দ দাশ যেমনটা বলেছেন একদিন।
মাসটি এখন অগ্রহায়ণ। বাংলার ঘরে ঘরে এখন শস্য-উৎসবের সময়। সব শ্রম ও আনন্দ ঢেলে মাঠে মাঠে যে সোনার ধান চাষ করেছেন চাষি, সেই শিশু গাছগুলো তারুণ্য পেরিয়ে শস্যবতী। সেগুলোর শরীরভরা পরিপুষ্ট ধানের প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর মায়া। দুই-তিনটি মাস ধরে চাষিরা এই শস্যবতী গাছেরই পরিচর্যা করেছেন, ফসলের অপেক্ষা করেছেন। মুঠো মুঠো সোনা হয়ে এই ধান একদিন কিষান-কিষানির কাছে যাবে, গোলায় উঠবে। এখন এই ধান ঘরে তোলার মুহূর্ত। মাঠ সেই মুহূর্ত বুকে নিয়ে ডাকছে চাষিকে।
এই ডাক চাষিরাই বোঝেন, অন্য কারও কাছে এই ডাকের সাড়া নেই। তাঁরা তাই বসে নেই—তাঁরা তো এই ধান তুলতেই যাঁর যাঁর মতো প্রস্তুত হয়ে আছেন। চাষির গলায় শব্দ হয়ে না–ই বাজুক, তবু এই গানই এখন কিষান-কিষানির বুকের ভেতর অবিরাম গীত হয়ে ফুটছে। কান পাতলেই শোনা যাবে ‘হেই সামালো ধান হো/কাস্তেটা দাও শাণ হো/জান কবুল আর মান কবুল/আর দেব না আর দেব না/ রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস কিষান-কিষানির সরল-তৃষ্ণার ভাষাকে এ রকমই একদিন প্রাণ দিয়েছিলেন।
মৌলভীবাজারের মাঠগুলো এখন যে সোনালি রঙে অঘ্রানের তাজা রোদে হাসছে, এই হাসিই যুগ যুগ ধরে এই বাংলার গ্রামগুলোর প্রাণ হয়ে আছে। যখন খরা, বন্যা ও দুর্যোগে এই মাঠ সোনার মতো হয়ে উঠতে পারে না, মানুষ বড় বেদনায় কাঁদতে থাকে। মানুষ বড় একা হয়ে যায়। এখানে-সেখানে যতই ওলটপালট হোক, এ ফসলটুকুই যেন গ্রামগুলোতে প্রাণের ধুকপুককে সতেজ রাখে, বাঁচিয়ে রাখে। শান্তি ও স্বস্তির শ্বাস এটুকুতে যতটা নির্মল, অন্য কোথাও নেই।
এবার আমন ফসলে কোনো বিপর্যয় ছিল না। দস্যু পোকামাকড়ের হানা ছিল না। সঠিক সময়ে বৃষ্টি নেমেছে। এতে ফসলও ভালো হয়েছে। হাওর মূলত বোরো ধানেই উদার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি না, এবার প্রকৃতি অন্যরকম ছিল। বৃষ্টি কম হয়েছে। জেলার কাউয়াদীঘি হাওরে পানি কম হয়েছে। অন্য বছর হাওর যতটা ডুবে থাকে, প্রশস্ত থাকে, এবার ততটা ডোবেনি। পানি কম হওয়ায় হাওরের যেসব জমিতে বোরো ছাড়া আর কোনো ফসলের চাষ কল্পনাতেও ছিল না কারও, সেসব জমিতে এবার রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছে।
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদও সে রকমই বললেন, এ বছর হাওরে পানি কম থাকায় অনেক নিচু জায়গায়ও আমন ধানের চাষ হয়েছে। যে জায়গাগুলোতে অতীতে কোনোদিন আমনের চাষ হয়নি। ফসলও খুব ভালো হয়েছে। এই ভালো ফলনের কারণে শুধু গ্রামের মাঠগুলোই না, কাউয়াদীঘি হাওরের বহু জায়গায় সোনালি ধান ঝলমল করছে।
একসময় অগ্রহায়ণের বিকেল ছিল এ রকমই, কেটে নেওয়া আঁটি আঁটি ধান কাঁধে নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি ফিরেছেন কৃষক। ফিরেছেন বাড়ির কাছে তৈরি ধানখোলায়। তারপর গরু-মহিষ দিয়ে উঠানে ও খোলায় ধান মাড়াই দেওয়া হয়েছে। কুলায় হাওয়া তুলে ধান ঝাড়াই করা হয়েছে। বিশাল হাঁড়ি-কড়াইয়ে ধান সেদ্ধ হয়েছে। অগ্রহায়ণে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের হাঁকডাকে বাড়িগুলো উৎসবমুখর থেকেছে। পাকা ধানের গন্ধে বাতাস আদুরে হয়েছে, উল্লাসে নেচেছে।
এই উল্লাসমুখরতা এখনো হারিয়ে যায়নি। তবে অনেক কিছু বদলে গেছে। মানুষনির্ভর চাষবাসের পদ্ধতি পাল্টে তাতে যুক্ত হয়েছে যন্ত্র। ধানকাটা, ধানমাড়াই অনেক জায়গায় যন্ত্রের কাছে চলে গেছে। গরু-মহিষ তাড়ানোর হাঁকের বদলে মাড়াই করার যন্ত্রের শব্দই কানে আসে এখন।
তা বদল যা–ই হয়েছে, মাঠ তার চেনা রূপ ধরে রেখেছে এখনো। এখানে-ওখানে চলছে পাকা ধান কাটা। কেউ তো কাঁধে ধানের আঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ধান সেদ্ধ, ধান শুকানো, ধানের ঘ্রাণ—সবই সেই পুরোনোই আছে। কিষান-কিষানি সেই ধানের গন্ধ ও কুঁড়ামাখা শরীরে এখনো অঘ্রানের মুহূর্তগুলো পার করেন। এখনো...‘ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে/ সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে’ এই মাঠ, এই হাওর মুখরই আছে।