প্রাচীন একটি মেলার কথা

প্রথম দিনেই জমে উঠেছে নাটোরের লালপুরের ঐতিহ্যবাহী বুধপাড়ার মেলাছবি: প্রথম আলো

প্রতিবছর কার্তিক মাস এলেই নাটোরের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা লালপুরের বাড়িতে বাড়িতে অতিথির আনাগোনা বেড়ে যায়। বিশেষ করে মেয়ে-জামাতা আর নাতি-নাতনিদের আগমনে বাড়িতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। আদর–আপ্যায়নের জন্য বাড়ির গৃহিণীরা নাড়ু–মুড়িসহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই উৎসব বুধপাড়ার কালীপূজার মেলা ঘিরে।

লালপুরের বুধপাড়া গ্রামে এই মেলা বসে বলে অনেকে একে বুধপাড়ার মেলা বলেও জানেন। ১০-২০ বছর নয়, ৫৩৫ বছর ধরে এখানে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আগে কার্তিক মাসজুড়ে মেলা হতো। এখন কোনো বছর ৯ দিন, আবার কোনো বছর ৭ দিন চলে এই মেলা। কালীপূজা উপলক্ষে মেলা বসলেও মেলাটি হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্মের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

এ বছরের মেলা শুরু হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। চলবে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সাত দিন।

বুধপাড়া মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ মোহন সাহার দেওয়া তথ্য অনুসারে, এখানে প্রথম ১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দে পূজা ও মেলার আয়োজন করা হয়। নবাবি আমলে বর্গি–হাঙ্গামায় ভারতের মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের খাগড়া থেকে ৬০ ঘর কাঁসাশিল্পী বুধপাড়ায় বসতি গড়েন। তাঁরাই মূলত এই মেলার উদ্যোক্তা। জমিদার পুণ্যচন্দ্র দাস ১৫০ বছর আগে এখানকার কালীমন্দিরের পাশে স্থাপিত গোবিন্দমন্দিরে প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমি দান করেন। এসব জমি থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সারা বছর মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা আরাধনা, পূজা–অর্চনা, হরিবাসসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। উপমহাদেশের প্রাচীনতম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম এই মন্দির ঘিরে বুধপাড়ার মেলা এখন সর্বজনীনতা পেয়েছে।

গতকাল দুপুরে বুধপাড়ার মেলায় গিয়ে দেখা গেল, সারি সারি মিষ্টির দোকান। প্রথম দিনের কারণে দোকানে ক্রেতার তেমন ভিড় ছিল না। মূলত শিশু–কিশোরেরা জিলাপি-সন্দেশ কিনছিল। এমনই একটি দোকানের নাম নিত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভান্ডার। দোকানের মালিক জিতেন দাস। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের মিষ্টির ব্যবসা শতবছরের। তার কর্তা (দাদা) ললিন দাস বেতের ঝুড়িতে করে হেঁটে হেঁটে সন্দেশ বিক্রি করতেন। তাঁর সন্দেশ একবার যে খেয়েছে, সে তাকে খুঁজে নিয়ে আবার মিষ্টি কিনেছে। এখন তার তৃতীয় বংশধরেরা সুনামের সঙ্গে মিষ্টি তৈরি করছেন। এবারের মেলায় তাঁরা সাত দিনে অন্তত ২০ মণ মিষ্টি বিক্রির আশা করছেন। তাঁর মতে, মেলার ৮০ ভাগ ক্রেতা মুসলিম সম্প্রদায়ের। তাই বেচাকেনায় ঘাটতি হয় না।

এ ছাড়া মেলায় এসেছে কাঠের আসবাব, চাদর, কম্বলসহ শিশুদের নানা ধরনের খেলনা। এখানকার মাটি আর কাঁসার তৈজসের ঐতিহ্য বহু পুরোনো। কারণ, যাঁরা এই মেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন কাঁসাশিল্পী। অনেকেই জানান, তাঁরা মেলায় এসেছেন মূলত কাঁসার সামগ্রী কিনতে।

মেলায় শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কারণ, শিশুদের জন্য নাগরদোলাসহ নানা ধরনের খেলার উপকরণ রয়েছে মেলায়। তবে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য বিশেষ কিছু আয়োজনও রয়েছে। যেমন বিনা মূল্যে ভোগ ও বলির পাঁঠার মাংস বিতরণ। দিনে ৫০–৬০টি পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। এর মাংস স্থানীয় হিন্দু ছাড়াও অন্য এলাকার হিন্দুদের মধে৵ বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়।

মন্দিরের পুরোহিত সুবোধ কুমার মজুমদার জানান, এখানকার কালীপ্রতিমা দৈর্ঘ্য ও উচ্চতায় দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এ কারণে এই প্রতিমা দেখার জন্য দেশের অন্যান্য জেলা থেকে, এমনকি পাশের দেশ ভারত ও নেপাল থেকে অনেকে বুধপাড়ার মেলায় আসেন।

মেলা বসেছে বুধপাড়া কালীবাড়ি চত্বরসহ আশপাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। আজিজুর রহমান বিশ্বাস বুধপাড়ার একজন ষাটোর্ধ বাসিন্দা। মেলার মধে৵ই তাঁর বসতবাড়ি। মেলা উপলক্ষে তাঁর বাড়িসহ আশপাশের অন্য সব ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। তাঁদের আপ্যায়নের জন্য তৈরি করা হয়েছে তিল-নারকেলের নাড়ু, তিলের খাজা ও মিষ্টিসামগ্রী। বুধপাড়ার বাসিন্দা বিচ্ছাদ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নতুন পোশাকে কয়েকজন অতিথি ঘোরাফেরা করছেন। তাঁরা এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। এই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। মেলা দেখার জন্য তাঁরা এ সময়ে জামাইয়ের বাড়িতে এসেছেন।

বিকেল ঘনিয়ে আসতে থাকায় দর্শনার্থীদের আগমন বাড়ছিল। মেলা চত্বর থেকে বের হয়ে আসার সময় দেখা গেল, পিচের সরু রাস্তার দুই ধারের ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে। সেখানে চলছিল নতুন নতুন দোকান বসানোর আয়োজন।