বগুড়ায় বাউলসুরের মূর্ছনায় মাতোয়ারা দর্শক
আলোঝলমলে মঞ্চে সারিবদ্ধভাবে বসা বাউলসাধকেরা। পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি। কারও হাতে একতারা, দোতারা, সেতার, খঞ্জনি, বেহালা। কেউ বাজাচ্ছেন ঢোল-তবলা-বাঁশি। সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ দর্শক। ৫০০ আসনের মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ। দর্শকের ভিড় মিলনায়তনের বাইরেও। মঞ্চে একসুরে বেজে উঠছে অসংখ্য লোকজ বাদ্যযন্ত্র আর একতারা। ঘোরলাগা সেই পরিবেশেই বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গলা মেলালেন সুকুমার বাউল। তিনি গাইলেন, ‘আপন মানুষ চেনা বড়ই দায় রে, আপন মানুষ বুঝা বড়ই দায়/ বুকের ভিতর কষ্টের মেলা, চাইলে তারে যায় না ভুলা/ আপন মানুষ সবচেয়ে বেশি আপনকে কাঁদায়...’।
আজ শনিবার রাতে বগুড়া শহরের শহীদ টিটু মিলনায়তনে জমে উঠেছিল বাউলগানের এই উৎসব। ‘সত্য বলো, সুপথে চলো...’ শীর্ষক দিনব্যাপী এই বাউল উৎসবের আয়োজক বগুড়া বাউলগোষ্ঠী। উৎসবে সুরের মূর্ছনায় মিলনায়তনভর্তি দর্শককে মুগ্ধ করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাউলশিল্পীরা। উৎসব উপভোগ করেন সারা দেশ থেকে আসা বাউলরাও। গানের ফাঁকে বাউলেরা তুলে ধরেন ‘মানুষ তত্ত্ব’ ও ‘গুরুভক্তি’র কথা।
রাত যত বেড়েছে, শহরের কোলাহল তত কমেছে, আর মাটির সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছে তত শহরজুড়ে। মধ্যরাত পর্যন্ত মাটির সুরের সেই মূর্ছনা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছেন দর্শকেরাও।
উৎসবের আয়োজক বগুড়া বাউলগোষ্ঠীর সভাপতি আবু সাঈদ সিদ্দিকী বলেন, এই উৎসব আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, জাতপাত ভেদাভেদ বা ধর্মের বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বাউল-ফকিরদের মিলনমেলার পাশাপাশি তাঁদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করতেই ভাব, জীবন, দর্শনতত্ত্বের এই আসর।
উৎসব আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসউদ করিম বলেন, ‘লোকসংস্কৃতির প্রাণভোমরা হলো বাউলগান। লোকায়ত জীবন আর সংস্কৃতির মূলমন্ত্র এটি। গানে গানে জাতপাতভেদে মানুষে মানুষে ভাবের দর্শন। এই আসরে বাউলগানের ভাব ও সুরে বাউল–দর্শন তুলে ধরা হয়েছে। বাংলার লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গানকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা থেকেই কয়েক বছর ধরে বাউল উৎসবের আয়োজন করেছি আমরা। বাংলার আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাউলদের দর্শকের কাছে তুলে ধরা সেই চেষ্টারই অংশ।’
উৎসবের উদ্বোধন করেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান। সকালে বাউলশিল্পীদের নিয়ে শোভাযাত্রা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মূল গানের অনুষ্ঠান শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য লালন করে বাউলধারার লোকগান। বাউলের দর্শন মানবতাবাদ। বাউলদের গানে গানে মানবতাবাদের এই চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটেছে, যা আমাদের সংস্কৃতিরও মূল সুর। বাউল সাধনা হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক সাধনা। বাউলেরা সংগীতের মাধ্যমে সম্প্রীতি ও সাম্যের দর্শন প্রচার করেন। বাউল–দর্শনের প্রভাব থাকলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না।’
অনুষ্ঠানে তিন গুণীজনকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। তাঁরা হলেন পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী (পুলিশ পদক পাওয়ায়), বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না এবং বাচিক শিল্পী শ্রাবণী সুলতানা।
উৎসবের মঞ্চে একে একে সুরের মূর্ছনা ছড়ান বাউল রাকা জারা, বাউল শুভ্র আজাদ, জগদীশ চন্দ্র রায়, বাউল লাকী সরকার, জীবন সরকার, জিহাদ সরকার, রুনা আকতার, সুমনা, বৃষ্টি, আশুতোষ প্রমুখ শিল্পীরা। তাঁরা শিকড় ও মাটির গান গেয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন।
উৎসবের পর্দা নামে সুকুমার বাউলের গানে, ‘বলব না গো, আর কোনো দিন ভালোবাস তুমি মোরে।’ মুহুর্মুহু করতালিতে মিলনায়তনে মুখরিত হয়ে ওঠে। বাউলসুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ দর্শক ফেরেন আপন ঠিকানায়।