বেশ কদিন ধরেই মাথা ঘুরাচ্ছিল, শরীরটা কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল ৩২ বছর বয়সী শিউলি আক্তারের। রোগী দেখতে এলাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসার খবরে স্বামীকে নিয়ে তিনি সেখানে হাজির হন। সেবা নিয়ে ফেরার পথে শিউলি বলছিলেন, ‘আমাদের বাড়ির পাশে স্কুলমাঠে বারডেমের বড় ডাক্তার এসেছেন শুনেছি। এখানে এসে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করালাম। পরীক্ষা করে দেখা যায় ডায়াবেটিসের মাত্রা অনেক বেশি। পরে চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিলেন। নিয়মিত হাঁটতে বললেন। সেখান থেকে ওষুধও ফ্রি পেলাম।’
ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় এই চিকিৎসাশিবির। আজ শুক্রবার গাজীপুর সদর উপজেলার সুকন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চিকিৎসাশিবিরে বিনা মূল্যে সেবা নিয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। এই কার্যক্রমে সহযোগিতা করে সলবিওন নামের ওষুধের ব্র্যান্ড।
সকাল ১০টার দিকে চিকিৎসা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলমাঠে প্রবেশের সময় প্রত্যেক সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে তাঁদেরকে নির্দিষ্ট বুথে পাঠানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কথা বলে ও প্রাথমিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র দেন। পরে একটি নির্দিষ্ট বুথে ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে রোগীরা ওষুধ সংগ্রহ করেন।
সুকন্দি গ্রামের বাসিন্দা তারেক হোসেন বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসার বিষয়ে এক দিন আগেই এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। টাকা ছাড়া চিকিৎসা করা হবে জেনে তিনি মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিয়েছেন। খুব আন্তরিক সেবা পেয়েছেন তাঁদের কাছ থেকে।
সেবা নিতে আসা লিজা বেগম বলেন, ‘বিনা মূল্যে চিকিৎসা পেয়েছি, সঙ্গে ওষুধও দিয়েছে। বছরে এক–দুবার এ রকম আয়োজন করলে আমাদের অনেক সুবিধা হতো।’
চিকিৎসাশিবিরে রোগীদের সেবা দেয় বারডেম হাসপাতালের এনডোক্রাইন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফিরোজ আমিনের নেতৃত্বে একটি চিকিৎসক দল। অন্যদের মধ্যে চিকিৎসা কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসক ফারিয়া আফসানা, হাসিব রহমান, রুশদা শারমিন, কাজী নাজমুল হোসেন, রুবায়েত হাসান চৌধুরী, শাহীন ইবনে রহমান প্রমুখ।
ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে চিকিৎসাশিবির আয়োজনে সমন্বয় করেন দেশের অন্যতম ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসকেএফের উপব্যবস্থাপক ওয়াহিদুজ্জামান, জ্যেষ্ঠ আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক আব্বাস আলী, প্রোডাক্ট ম্যানেজার তনয় কুমার সাহা প্রমুখ।
ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ চিকিৎসাশিবিরে ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন জয়দেবপুরের ছায়াবীথি এলাকার বাসিন্দা আরমান আলী (৪০)। তিনি বলেন, ‘এখানে টাকা ছাড়াই চিকিৎসাও করাতে পারছি, আবার ওষুধও দিয়ে দিছে। খুব উপকার হইল।’
২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের মানুষ। দুই বন্ধুকে ছেড়ে আসতে অস্বীকৃতি জানানোয় জঙ্গিদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। সাহসী এই তরুণের নামে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন গড়েছে তাঁর পরিবার। ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। ফারাজ আইয়াজ হোসেন বন্ধুত্ব, সাহস ও মানবিকতার যে নিদর্শন দেখিয়েছিলেন, সেই অনুভূতি ধারণ ও লালন করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর নামে গড়া ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্যসহায়তা প্রদান, হতদরিদ্র রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা, ওষুধ প্রদানসহ সারা দেশে নানা মানবিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসের উপব্যবস্থাপক ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সারা দেশেই ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প ও বিনা মূল্যে ওষুধ দিয়ে থাকি। এরই ধারাবাহিকতায় ওই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দুই শতাধিক রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে।’
চিকিৎসা ক্যাম্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন অধ্যাপক ফিরোজ আমিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ডায়াবেটিসের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ডায়াবেটিস থেকে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিচ্ছে। আমাদের সবার নিজের রোগ সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের শরীরের জটিলতার কারণে আমরা অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সে কারণে এই এলাকার মানুষকে সচেতন করতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির পক্ষ থেকে এবং ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এই ফ্রি ডায়াবেটিস ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। আমরা ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে ফ্রি চিকিৎসা ও বিনা মূল্যে ওষুধও দিয়েছি। চিকিৎসা দিয়েই শেষ নয়, যাঁদের জটিল রোগ ধরা পড়বে, আমরা তাঁদের বারডেম হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’