শীতে বেড়েছে ঝুরি পিঠার চাহিদা, ব্যস্ত সময় কাটছে হাট পাঁচিল গ্রামের বাসিন্দাদের
যমুনা নদীর ভাঙনকবলিত গ্রামটির নাম হাট পাঁচিল। গ্রামটিতে ঢোকার মুখে রাস্তার দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ কিছু একটা রোদে শুকাতে দিচ্ছিলেন। কাছে যেতেই দেখা গেল, সেগুলো চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি ঝুরি পিঠা। পরে এগুলো রোদে শুকিয়ে মাটির পাত্রে বালু দিয়ে ভেজে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের ছোট্ট এই গ্রামে প্রায় বছরজুড়েই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামটির তৈরি ঝুরির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে তিন শতাধিক পরিবারের অন্তত এক হাজার নারী-পুরুষ ঝুরি পিঠা তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সেখানকার ঝুরি পিঠা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বছরের অধিকাংশ সময় এই ঝুরি তৈরি হলেও শীতকালে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও মেলার বাজারে এর চাহিদা বেশি থাকে। এ কারণে শীতকালকে পিঠাটি তৈরির প্রধান মৌসুম হিসেবে ধরা হয়।
ঝুরি পিঠা তৈরি করে আসছে এমন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে চুলার ওপর বড় একটি পাতিলে পানি গরম করে এতে পরিমাণমতো আতপ চালের গুঁড়া ও লবণ দিয়ে দিতে হয়। এরপর সেগুলো সিদ্ধ করে খামির তৈরি করা হয়। এ পর্যায়ে খামির থেকে ছোট ছোট বল আকৃতির দলা তৈরি করা হয়। সেই দলাগুলো ঝাঁজর বা মাটির ছাঁচের ওপর ঘষে ঘষে কাঁচা ঝুরি তৈরি করা হয়। পরে সেই ঝুরি তিন দিন ধরে রোদে শুকিয়ে গরম বালুর মধ্যে ভেজে খাবারের উপযোগী করা হয়।
গত বুধবার হাট পাঁচিল গ্রামে দেখা যায়, গ্রামের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন খালি জায়গায় রোদে ঝুরি শুকানোর কাজ করছেন। কেউ ঝুরি তৈরির জন্য আতপ চালের গুঁড়া গরম পানিতে সেদ্ধ করে খামির তৈরি করছেন। কেউ মাটিতে মাদুর পেতে এতে কাপড় বিছিয়ে খামির মাটির ছাঁচে ঘষে ঝুরি তৈরি করছেন। আরও কয়েকজন সেগুলো রোদে ছড়িয়ে দিয়ে শুকানোর ব্যবস্থা করছেন। সেগুলো রোদে শুকানো হয়ে গেলে বাড়িতে রান্না ঘরে চুলার আগুনে নারীরা সেগুলো মাটির পাত্রে বালু দিয়ে ভেজে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন।
প্রথমে চুলার ওপর বড় একটি পাতিলে পানি গরম করে এতে পরিমাণমতো আতপ চালের গুঁড়া ও লবণ দিয়ে দিতে হয়। এরপর সেগুলো সিদ্ধ করে খামির তৈরি করা হয়। এ পর্যায়ে খামির থেকে ছোট ছোট বল আকৃতির দলা তৈরি করা হয়। সেই দলাগুলো ঝাঁজর বা মাটির ছাঁচের ওপর ঘষে ঘষে কাঁচা ঝুরি তৈরি করা হয়।
বাড়ির পাশের উঠানে ঝুরি শুকাচ্ছিলেন তানিয়া খাতুন (৩২) নামের এক গৃহবধূ। তিনি বলেন, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সবাই মিলে ঝুরি তৈরির কাজ করেন। এতে যা উপার্জন করেন—তা দিয়ে পরিবারের খরচ চলে। সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে এ কাজ করেন তিনি। সবাই মিলে দিনে ৮০ কেজি ঝুরি তৈরি করতে পারেন।
যমুনার ভাঙনের কবলে সব হারিয়ে একসময় পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছিলেন গ্রামটির কয়েকটি পরিবার। এর মধ্যে এ কাজটি করে নিজেদের এমন অবস্থা ঘুচিয়েছেন হোসনে আরা (৫২), আলো বেগম, সুফিয়া খাতুনসহ অন্য নারীরা। তাঁরা জানান, কেজি প্রতি ঝুরি বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকায়। কেজিতে তাঁদের ১৫ থেকে ২৫ টাকা লাভ হচ্ছে। তাঁদের তৈরি ঝুরির চাহিদা থাকায় বিক্রিতেও কোনো বেগ পোহাতেও হচ্ছে না। বাড়ি থেকেই পাইকারেরা এগুলো সংগ্রহ করেন।
পাইকারি ঝুরি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, ‘সাত বছর ধরে আমি এখান থেকে ঝুরি পাইকারি কিনে বিভিন্ন গ্রামের জলসায়-মেলাতে বিক্রি করছি। নানা পালা-পার্বণে, উৎসবে, গ্রামীণ মেলায় ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার হিসেবে ঝুরি পিঠার দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা আছে। ঝুরি তৈরি করে বিক্রিতে কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না। লাভও একেবারে কম হচ্ছে না।’
হাট পাঁচিল গ্রামের একটি চালকলের স্বত্বাধিকারী আবদুল আলিম জানান, ঝুরি তৈরিকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে এখনো চারটি চালকল আছে। ঝুরি তৈরির জন্য এসব চালকল থেকেই আতপ চালের গুঁড়া নিয়ে থাকেন প্রস্তুতকারকেরা। অনেকেই বাকিতেও দেওয়া হয়।
হাট পাঁচিল গ্রামের নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এই ঝুরি তৈরির কাজ করে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন বলে মন্তব্য করেন উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মিনা খাতুন। তাঁর মতে, প্রয়োজনীয় পুঁজি সহায়তা পেলে এ পেশায় তাঁরা আরও ভালো করতে পারবেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের আওতায় এসব গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা চলমান।