‘কত বছর পর আমার বুকের হারানো ধন খুঁজে পেলাম’

২১ বছর পর হারানো ছেলে মতিউর রহমানকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন বাবা সহিদুল ইসলাম ও মা মর্জিনা বেগম। শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের শূন্যরেখায়
ছবি: রাজিউর রহমান

ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন ঠিক বেলা ২টা ২২ মিনিট। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের শূন্যরেখায় ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে হেঁটে হেঁটে বাংলাদেশি অংশে এলেন মতিউর রহমান (৩৬)। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে মতিউরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা মর্জিনা বেগম ও বোন সাইফুন নাহার। পেছন থেকে বাবা সহিদুল ইসলামও মতিউরকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। স্বজনদের কান্না দেখে মতিউরও কেঁদে ফেললেন।

হারিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ২১ বছর পর মতিউর রহমান দেশে ফেরার পর শুক্রবার পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। এর আগে ২০০২ সালে ১৫ বছর বয়সে মা-বাবার বুক শূন্য করে হারিয়ে গিয়েছিলেন মতিউর। তবে মতিউর কবে, কীভাবে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন, সেই জট এখনো খোলেনি।

ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে মা মর্জিনা বেগম বলছিলেন, ‘কত বছর পর আমার বুকের হারানো ধন খুঁজে পেলাম। কলিজাটা ফিরে এল, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে। যাঁরা আমার মানিকটাকে ফেরত দিল, তাঁদের জন্য সারা জীবন দোয়া করব।’

মতিউর রহমানকে দেশে ফিরিয়ে দিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিল ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মতিউরকে পরিবারের কাছে তুলে দিতে বাংলাদেশে এসেছেন শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের মানসিক চিকিৎসক সয়োরালি কে কোন্ডইলকার ও সমাজকর্মী নীতিশ শর্মা। মতিউর বাংলাদেশে প্রবেশের সময় বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন পুলিশ, বিজিবি ও ভারতের ফুলবাড়ী ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ঠাকুরগাঁও জেলা সদর উপজেলার আখানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ দেবীডাঙ্গা গ্রামের সহিদুল ইসলাম ও মর্জিনা বেগম দম্পতির বড় ছেলে মো. মতিউর রহমান। তাঁর জন্ম ১৯৮৭ সালে। ২০০২ সালে ছেলে হারানোর বিষয়ে ঠাকুরগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন মতিউরের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য সহিদুল ইসলাম। এরপর তাঁরা পুরো বাংলাদেশে খুঁজেও তাঁর সন্ধান পাননি।

অনেক দিন পর মা-বাবার কাছে এসে ভালো লাগছে। এখন আমি বাড়ি যেতে চাই।
মতিউর রহমান, ২১ বছর পর ফিরে আসা ছেলে

শুক্রবার মতিউরকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ফেরত দেওয়া হবে—এমন সংবাদ পেয়ে সকালে তাঁর মা-বাবা, বোন ও স্বজনেরা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের শূন্যরেখায় আসেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে আখানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রোমান বাদশাহ, একই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হুমায়ুন কবীরও আসেন। হারানো ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাংলাবান্ধায় বসে অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। দুপুরে মতিউরকে নিয়ে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে বিকেলে বাড়ির পথে রওনা দেন স্বজনেরা। তাঁদের সঙ্গে শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকসহ দুই প্রতিনিধিও যান।

দেশে ফেরার পর মতিউর রহমান বলেন, ‘অনেক দিন পর মা-বাবার কাছে এসে ভালো লাগছে। এখন আমি বাড়ি যেতে চাই। আমার খুব বেশি কিছু মনে নেই।’

আট বছর ও পাঁচ বছর বয়সী দুই ছেলেকে নিয়ে ভাই মতিউরকে গ্রহণ করতে আসেন ছোট বোন সাইফুন নাহার। তিনি বলেন, ‘আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, ভাইয়া (মতিউর) তখন নবম শ্রেণিতে পড়ত। তখনই সে হারিয়ে যায়। এরপর আমার বিয়ে হয়েছে, দুই ছেলে হয়েছে। কিন্তু ভাইয়াকে খুঁজে পাইনি। ২১ বছর পর আজকে ভাইয়াকে পেয়ে ঈদের দিনের চেয়েও বেশি খুশি লাগছে। চোখের জল দিয়ে তাকে বরণ করেছি, তবে আজকের এই চোখের জল ছিল আনন্দের।’

মতিউর রহমানের বাবা সহিদুল ইসলাম বলেন, ২১ বছর পর ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন। এর চেয়ে আর আনন্দের কী আছে? তবে মনের মধ্যে এক বেদনা কাজ করছে, সেটা হলো তাঁকে খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতার কষ্ট। দুই দেশের যাঁরা তাঁর ছেলেকে ফেরত দিতে সহায়তা করেছেন, তাঁদের প্রতি তিনি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন।

মতিউরকে দিতে আসা ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের সমাজকর্মী নীতিশ শর্মা বলেন, ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার রাস্তা থেকে মতিউর রহমানকে তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছিলেন। পরে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়ার পর জানতে পারেন, তাঁর বাড়ি বাংলাদেশে। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে আজকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দিতে পেরে অনেক আনন্দিত।

২৭ জুন দেশে ফেরার কথা ছিল মতিউরের। ওই দিন ফিরতে না পেরে ভারতের ফুলবাড়ী সীমান্ত থেকে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে তাঁর অনুমতিপত্রের (এক্সিট পারমিট) প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি না থাকায় ওই দিন তিনি ফিরতে পারেননি।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা–মা। শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের শূন্যরেখায়
ছবি: প্রথম আলো

২০১৯ সালের জুনে ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার রাস্তা থেকে মতিউরকে উদ্ধার করেন শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের সমাজকর্মীরা। তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন মতিউর। এরপর তাঁর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকেরা তাঁকে চিকিৎসা দেন। মতিউরকে সম্ভাব্য সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। একসময় জানা যায়, তাঁর বাড়ি বাংলাদেশে। এরপর করোনা মহামারি শুরু হলে মতিউরের পরিবারের সন্ধানের বিষয়টি স্থবির হয়ে পড়ে। শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা রাস্তায় থাকেন, তাঁদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কাজ করে।

করোনা মহামারির ভয়াবহতা কমে আসার পর আহমেদাবাদের বেসরকারি সংস্থা ‘স্নেহালয়’ বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হয়। মতিউরকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের রাহা নবকুমার ও তাঁর স্ত্রী তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নীতিশ শর্মা। তিনি একজন বাঙালি। রাহা নবকুমার ও তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে একসময় ঠাকুরগাঁওয়ে মতিউরের স্বজনদের খুঁজে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন