চট্টগ্রামের পুরোনো বইপাড়ায় সেই ভিড় নেই

অমর বইঘরে বই দেখছেন এক পাঠক। সম্প্রতি নগরের নুপুর মার্কেট এলাকায়ছবি: জুয়েল শীল

একসময় নিউমার্কেট, জলসা সিনেমা হল কিংবা আন্দরকিল্লার বইপাড়ায় সকাল-বিকেল ভিড় লেগে থাকত। নিউমার্কেটের একতলায় উজালা ও নিউজফ্রন্ট, দোতলায় বইঘর আর চারতলায় মনীষায় ভিড় লেগে থাকত সব সময়। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে এই বইয়ের দোকানগুলোয় জমজমাট বেচাকেনা হতো।

গত শতকের আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকেও ভারত-বাংলাদেশের খ্যাতনামা কোনো লেখকের সাম্প্রতিক বই, রিডার্স ডাইজেস্ট, দেশ পত্রিকা, নানা ধরনের সাময়িকী, পেঙ্গুইন কিংবা ফেবার অ্যান্ড ফেবার প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার বই, রুশ সাহিত্য—সবই মিলত এই পাড়ায়। নিউমার্কেট পার হয়ে জলসা সিনেমা হলের নিচে পাশাপাশি ছিল শুকতারা আর কারেন্ট বুক সেন্টার। এর অপর পাশে কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি। হেঁটে হেঁটে বই দেখা আর বই নিয়ে আলাপে ভেসে যাওয়ার সুযোগ ছিল তখন। সত্তর-আশির দশকে এসব বইয়ের দোকানে নিয়মিত আসতেন হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদ, মোহাম্মদ রফিক কিংবা মুনতাসীর মামুনের মতো লেখক ও সাহিত্যিকেরা।

কোনো বই হয়তো প্রিন্ট আউট। কোনো দোকানে নেই। এমন বই পাওয়ারও উপায় ছিল তখন। পুরোনো বইয়ের দোকান ‘অমর বই ঘর’–এ গেলে মিলত সেসব বই। সেখান থেকে বই ভাড়া নিয়েও পড়ার সুযোগ ছিল। কেবল অমর তো নয়, জলসা মার্কেটের নিচে এমন সারি সারি পুরোনো বইয়ের ব্যবসা ছিল। নগরের পুরোনো বইয়ের দোকানে নব্বইয়ের দশকে নিয়মিত যেতেন এমন পাঠকেরা জানালেন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে হেমিংওয়ের উপন্যাস পর্যন্ত মিলত সেসব বইয়ের দোকানে।

অমর বই ঘরের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আবুল হোসেন। এখন প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করেন তাঁর ছেলে মো. শাহজাহান। তিনি জানান, প্রায় ৫৪ বছর আগে ১৯৭০ সালের দিকে অমর বই ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্লভ ও পুরোনো এমন কিছু বই পাওয়া যাচ্ছিল, যা ছিল না কোথাও। এ কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অমর বই ঘরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে চারটি শাখা রয়েছে। তবে আগের সেই জৌলুশ এখন নেই।

সময়ের পথরেখা ধরে পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে, চট্টগ্রামে একসময় চলন্তিকা, পাঠক-বন্ধু, বইঘর, উজালা বুক সেন্টার, নিউজফ্রন্ট, কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, মনীষা লাইব্রেরি, অমর বই ঘর, কথাকলি, পিপলস বুক, ডি রোজিও নামের গ্রন্থরাজ্য গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে আন্দরকিল্লায় কোহিনূর লাইব্রেরি, ইসলামিয়া লাইব্রেরির নাম এখনো পাঠকের মুখে মুখে ঘুরেফিরে আসে। এসব বইয়ের দোকানগুলোয় চেনা-অচেনা কত লেখকেরই–না বই ছিল। লিটল ম্যাগাজিন, পুস্তিকা, দেশ-বিদেশের পত্রিকাও  ছিল। কালের বিবর্তনে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই হারিয়ে গেছে। কোনোটি টিকে আছে এখনো। অবশ্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েক বছর ধরে সাড়া জাগিয়েছে বাতিঘর কিংবা নন্দনের মতো প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠক-লেখকেরা যাচ্ছেন।

পুরোনো দোকানের খোঁজখবর নিতে গিয়ে কথা হলো কবি শিশির দত্তের সঙ্গে। একঝটকায় তিনি ফিরে গেলেন ষাট কিংবা সত্তরের দশকে চট্টগ্রামের বইপাড়ার অলিগলিতে। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, ষাট ও সত্তরের দশকে নগরের নিউমার্কেট-কেন্দ্রিক বেশ কিছু বইয়ের দোকান ছিল। নিউমার্কেটের দোতলায় ছিল বইঘরের অবস্থান। বইঘরে নিজস্ব প্রকাশনা ও অন্যান্য প্রকাশনীর বই পাওয়া যেত। পাশাপাশি ছিল কলকাতার নানা বইপত্র। নিচতলায় ছিল নিউজফ্রন্ট। সেখানে ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার কাগজ পাওয়া যেত।

শিশির দত্ত বলেন, উজালা বুক সেন্টারে গল্প ও উপন্যাসের সমাহার ছিল। বিশেষ করে বিমল মিত্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিমল করসহ নানা সাহিত্যিকের বই পাওয়া যেত। অন্যদিকে কারেন্ট বুক সেন্টারে কবিতার বই, লিটল ম্যাগাজিন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত কণ্ঠস্বরসহ নানা প্রকাশনা পাওয়া যেত। এ ছাড়া ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে পিপলস বুক সেন্টারে কলকাতা থেকে আমদানি করা বইগুলো পাওয়া যাচ্ছিল।

‘কোনোমতে টিকে আছি’

১৯৫১ সালের কোনো একসময়ে চট্টগ্রাম নগরে মুসলিম উচ্চবিদ্যালয়ের নিচে চালু হয় কারেন্ট বুক সেন্টার। বইপ্রেমী মোহাম্মদ আমিন তালুকদার গড়ে তুলেছিলেন বইপত্রের সেই সাম্রাজ্য। ১৯৬৭ সালের দিকে দোকানটি চলে যায় জলসা সিনেমা হলের পাশে। লিটল ম্যাগাজিন, দেশ-বিদেশের সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনসহ নানা রকমের বইপত্র পাওয়া যেত কারেন্ট বুক সেন্টারে। দোকানের সুনাম শহরজুড়ে।

বই কেনার পাশাপাশি এখানে আড্ডা দিতেন হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, আল মাহমুদ কিংবা কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনের মতো ব্যক্তিরা। বিক্রিও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এখন সেই জৌলুশ নেই।

কারেন্ট বুক সেন্টারের বর্তমান অবস্থান কাজীর দেউড়ির ভিআইপি টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায়। গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ছোটখাটো দোকানটিতে বসে আছেন প্রতিষ্ঠাতা আমিন তালুকদারের ছেলে মোহাম্মদ শফিক। চারটি তাকে সাজানো হরেক রকম বই। ইংরেজি সাহিত্য যেমন আছে তাকে, তেমনি আছে বাংলা সাহিত্যের নানা বই।

আলাপের শুরুতেই কিছুটা হতাশার কথা শোনালেন মোহাম্মদ শফিক। বললেন, অনেক বইয়ের দোকান চট্টগ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে। বইঘর, মনীষা, কথাকলি, নিউজফ্রন্ট—এসব দোকানে পাঠক ও লেখকের সম্মিলন হতো। কারেন্ট বুক সেন্টারে কত কবি-সাহিত্যিকই না এসেছেন। চট্টগ্রামের অনেক সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীরাও ঢুঁ মারতেন এখানে। কিনে নিতেন পছন্দের বই। এখন সেই জৌলুশ আর নেই।

কেন জৌলুশ নেই, তা-ও বললেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এই বইপ্রেমী। বলেন, ‘একসময় পাঠকের কাছে বই ছিল বিনোদন ও জ্ঞান অন্বেষণের অন্যতম উপকরণ। এখন প্রযুক্তির মারফতে নানা মাধ্যমে পাঠক ব্যস্ত হয়ে গেছেন। তবে এর মধ্যেও আমরা টিকে আছি। চট্টগ্রামের সবচেয়ে পুরোনো বইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে আমরা কোনোমতে বেঁচে আছি।’
ফিরে আসবে বইঘর

বইঘরের নাম এখনো কবি-সাহিত্যিকদের মুখে মুখে। নগরের নিউমার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ১৯৬১ সালে বইঘর চালু হয়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রকাশনীর বই যেমন মিলত সেখানে, তেমনি নিজেরাও বই প্রকাশ করত। এটি সৈয়দ মোহাম্মদ শফি চালু করেছিলেন। বইঘরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। বইঘর থেকে বের হয়েছিল হাসান হাফিজুর রহমান ও শহীদ কাদরীর মতো লেখকের কাব্যগ্রন্থ।

শুধু বই নয়, আড্ডাও চলত বইঘরকে কেন্দ্র করে—এমনটাই জানালেন সৈয়দ মোহাম্মদ শফির সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ জামাল শফি। তিনি বলেন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেই জমে যেত আড্ডা। প্রায় সময় আসতেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ থেকে শুরু করে অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। পাঠকদের সঙ্গে চলত নানা আলাপ। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বইঘর আর টিকে রইল না। তবে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে আবার বইঘর চালু হবে।