পাবনার সাঁথিয়ায় এবার তিন থেকে চার সপ্তাহ বিলম্বে উঠবে নতুন পেঁয়াজ

জমি ভেজা বা কর্দমাক্ত থাকলে বীজ হিসেবে রোপণ করা কন্দ পেঁয়াজ দ্রুত পচে যায়। তবে কিছু উঁচু শুকনা জমিতে পেঁয়াজ লাগানো যাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে পাবনার সাঁথিয়ার বায়া গ্রামের একটি খেতে
ছবি: প্রথম আলো

দেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় পাবনার সাঁথিয়ায়। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলে আগাম বা মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজের আবাদ শুরু করেন চাষিরা। অথচ এবার গত বছরগুলোর তুলনায় তিন সপ্তাহ পার হওয়ার পরও অধিকাংশ জমিতে আবাদ শুরু করা যায়নি। কবে আবাদ শুরু করা যাবে, তা–ও অনিশ্চিত।

কারণ, তাঁর পেঁয়াজের জমি অতিবৃষ্টির কারণে এখনো কর্দমাক্ত হয়ে আছে। ফলে পেঁয়াজের ভান্ডার বলে পরিচিত এ উপজেলার হাটে এবার দেরিতে আগাম বা মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ আসবে।

সাঁথিয়ার পেঁয়াজচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় পেঁয়াজের জমিতে পানি জমে গিয়েছিল। অনেক জমি থেকেই সেই পানি ভালোমতো শুকায়নি। ফলে চাষের উপযোগী না হওয়ায় এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদে তিন থেকে চার সপ্তাহ (এক মাস) দেরি হচ্ছে। তাই নতুন পেঁয়াজ উঠতেও তিন থেকে চার সপ্তাহ দেরি হবে। প্রতিবছর যেখানে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন পেঁয়াজ বাজারে ওঠে, এবার সেখানে নতুন পেঁয়াজ উঠতে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে তাঁরা জানান।

কৃষকেরা জানান, মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ আবাদের সময় জমি কোনোমতেই ভেজা থাকা চলবে না। জমি ভেজা বা কর্দমাক্ত থাকলে বীজ হিসেবে রোপণ করা কন্দ পেঁয়াজ দ্রুত পচে যায়। তবে কিছু উঁচু শুকনা জমিতে সপ্তাহখানেক আগেই পেঁয়াজ লাগানো গেছে।

সাঁথিয়ার আটিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক মকবুল হোসেন গত বছর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে মুড়িকাটা পেয়াঁজ আবাদ শুরু করেছিলেন। অথচ এবার এখনো তাঁর পেঁয়াজের খেত ফাঁকা পড়ে আছে। তিনি বলেন, ‘বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা ও দাম দুইই এবার বেশি। তাই ভাবছিল্যাম, এবার একটু আগেভাগে পেঁয়াজের আবাদ করব, যাতে ভালো দাম পাই। কিন্তু জমিতে জো (জমি শুকিয়ে চাষের উপযোগী হওয়া) না আসায় সেই সুযোগ আর পাইল্যাম না।’

এদিকে এবার বাজারে পেঁয়াজের অগ্নিমূল্যের প্রভাবে বীজের (কন্দ পেঁয়াজ) দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। মাসখানেক আগেও যে কন্দ পেঁয়াজের দাম প্রতি মণ চার হাজার থেকে সাড়ে হাজার টাকা ছিল, এখন তার দাম দ্বিগুণ হয়ে ৮–৯ হাজার টাকা হয়েছে।

ধান কাটার পর সেই জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপন করছেন কৃষক। মাটি নরম থাকায় কোনো রকম চাষ ছাড়াই বুনে দিচ্ছেন এই পেঁয়াজ। শনিবার পাবনা সদরের মাটিবাড়িয়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলার বায়া, আটিয়াপাড়া, পুন্ডুরিয়া, কাশিনাথপুর, গোপালপুরসহ পাঁচ-ছয়টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার বেশির ভাগ জমিই এখনো ভেজা ও কর্দমাক্ত। সেখানে পেঁয়াজ আবাদ শুরু হয়নি। তবে অল্প কিছু উঁচু শুকনা জমিতে পেঁয়াজ লাগানো হয়েছে। বায়া গ্রামের ফসলের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ওই মাঠ আশপাশের এলাকার পেঁয়াজের জমি থেকে বেশ উঁচু। এ পর্যন্ত এ মাঠে চার থেকে পাঁচজন কৃষক মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। বাকি আরও শতাধিক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদের প্রস্তুতি চলছে।

এ ফসলের মাঠে তিন-চারজন শ্রমিকের সঙ্গে নিয়ে পেঁয়াজের বীজ (কন্দ পেঁয়াজ) রোপণ করছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার জমিতে পানি জমে না। তারপরও মাটি কিছুটা ভেজা থাকায় এবার অন্তত ১৫ দিন আবাদে দেরি হয়া গেল। এবার কন্দ বা বেছন পেঁয়াজের ম্যালা দাম। এত দামের বীজ কিইন্যা কীরম ফলন আর দাম পাব, তা নিয়া কিছুটা চিন্ত্যায় আছি। সময়মতো আবাদের সুযোগ পালি এই চিন্ত্যা করা লাগত না।’

পেঁয়াজচাষিরা জানান, সাঁথিয়ায় পেঁয়াজের আবাদ হয়ে থাকে দুই পদ্ধতিতে। এর একটি হলো মূলকাটা বা মুড়িকাটা (আগাম) ও অপরটি হলো হালি। মুড়িকাটা পদ্ধতিতে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পেঁয়াজের আবাদ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। এই পদ্ধতিতে অঙ্কুরিত পেঁয়াজ (কন্দ) জমিতে রোপণ করা হয়। মুড়িকাটা পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। অন্যদিকে হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজের আবাদ করে মার্চ-এপ্রিলে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। এ পদ্ধতিতে পেঁয়াজের চারা জমিতে রোপণ করা হয়। হালি পেঁয়াজ দীর্ঘদিন ঘরে সংরক্ষণ করা যায়।

উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সাঁথিয়া উপজেলায় এবার ১৬ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা ও বাকি প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে হালি পদ্ধতির পেঁয়াজের আবাদ হবে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সাঁথিয়ায় ৩০০ হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি কার্যালয় জানিয়েছে। অথচ এর আগের বছরগুলোতে এমন সময়ে কমপক্ষে ১ হাজার হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়েছিল।

সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন, ‘এবার অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় আগাম পেঁয়াজের আবাদ দুই থেকে তিন সপ্তাহ পিছিয়েছে। তাই নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতেও কিছুটা দেরি হবে। উপজেলার উঁচু জমিতে এরই মধ্যে আবাদ শুরু হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় আশা করছি, শিগগিরই বাকি জমি শুকিয়ে যাবে এবং সব আবাদ শেষ হবে।’