৭০ বছর পর পৈতৃক ভিটায় এসে আপ্লুত শামছুল হকের দুই মেয়ে
ছোটবেলায় একবার পৈতৃক ভিটা টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মাইঠান গ্রামে এসেছিলেন। কিন্তু সেই স্মৃতি মনে নেই তাঁদের। এরপর কেটে গেছে প্রায় ৭০ বছর। আর আসা হয়নি। এর মধ্যে মা–বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছে। তাঁর বাবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। বাবার ১০৫তম জন্মদিনে আবার এলেন। সারা দিন ঘুরে দেখলেন বাবার স্মৃতিচিহ্ন। এসব দেখে আবেগাপ্লুত হলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ভাষাসৈনিক শামছুল হকের দুই মেয়ে।
তাঁদের মধ্যে শাহীন ফাতেমা দিল যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং শায়েকা দিল যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার জ্যোতিঃপদার্থবিদ। শাহীন ফাতেমার জন্ম ১৯৫১ সালের ৯ এপ্রিল। শায়েকার জন্ম ১৯৫২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর।
শামছুল হকের ভাতিজা চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম ওরফে স্বপন চাচার নামে গড়া শামছুল হক ফাউন্ডেশনের সভাপতি।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি সকালে টাঙ্গাইলে পৌঁছে শহরের জেলা সদর গেটে (শামছুল হক তোরণ) বাবা শামছুল হকের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দুই বোন। তাঁরা টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খানের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ফজলুর রহমান খান তাঁদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি উপহার দেন। পরে কালিহাতীর এলেঙ্গায় শামছুল হকের নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখান থেকে কালিহাতীর জোকারচরে শামছুল হকের কবরে (২০০৭ সালের মে মাসে সন্ধান পাওয়া) ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তাঁরা। বিকেলে শাহীন ফাতেমা দিল ও শায়েকা দিল দেলদুয়ার উপজেলার মাইঠানে পৈতৃক ভিটায় যান। এ সময় সেখানে গ্রামের বাসিন্দারা ফুল ছিটিয়ে তাঁদের বরণ করে নেন।
মাইঠান টেউরিয়া এম কে দাখিল মাদ্রাসা মাঠে শামছুল হকের জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটার আয়োজন করা হয়। সেখানে শামছুল হক ফাউন্ডেশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম মোস্তফা, দেউলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাহমিনা হক বক্তব্য দেন।
এ সময় শামছুল হকের মেয়ে শাহীন ফাতেমা দিল বলেন, ‘আমি ও আমার বোন টাঙ্গাইলে এসে অনেক খুশি হয়েছি। আপনারা আমার বাবার স্মৃতি ধরে রেখেছেন। ওনাকে মনে রেখেছেন, তাতে আমরা গর্বিত।’ পরে তাঁরা দেলদুয়ারের এলাসিনে ধলেশ্বরী নদীর ওপর শামছুল হক সেতু অতিক্রম করে ঢাকায় যান।
শামছুল হক ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, শামছুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক করেন। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামছুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আফিয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। পরে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই রাজনীতিবিদ। ১৯৫৩ সালে তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী আফিয়া খাতুন উচ্চশিক্ষার জন্য নিউজিল্যান্ডে চলে যান। তখন শামছুল হক কারাগারে ছিলেন। ১৯৬১ সালে শামছুল হকের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান আফিয়া খাতুন। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর শামছুল হকের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৬৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অসুস্থ মাকে দেখার জন্য বাড়িতে আসেন। পরদিন বাড়ি থেকে চলে যান। এরপর আর তাঁর খোঁজ মেলেনি।
আবুল কালাম মোস্তফা আরও বলেন, শামছুল হকের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আফিয়া হক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাকিস্তানি নাগরিক আনোয়ার দিলকে বিয়ে করেন। শামছুল হকের দুই মেয়ে সেখানেই বড় হন।
শামছুল হক ফাউন্ডেশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৮ সালে বামপন্থী রাজনীতিক ও লেখক বদরুদ্দীন উমরের মাধ্যমে শামছুল হকের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। পরে ঢাকায় এলে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে জানতে পারেন শামছুল হকের দুই মেয়ের কথা। পরে ২০১৩ সালে টেলিফোনে শাহীন ফাতেমা দিল ও শায়েকা দিলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তখন থেকে তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছিল।
সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, শামছুল হকের সন্তানেরা আছেন, তাঁরা অনেক গুণী, অনেকে তা জানতেন না। বাবার স্মৃতি দেখে দুই বোন আপ্লুত হয়েছেন।