১৭০ টাকা মজুরিতে চা-বাগানের কাজে ফিরলেন শ্রমিকেরা
৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে টানা ১৯ দিন আন্দোলনের পর চা–বাগানের কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকেরা। গতকাল শনিবার রাতে মালিকপক্ষের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর শ্রমিকদের ১৭০ টাকা মজুরি দিতে রাজি হন বাগানমালিকেরা। এরপর চা-বাগানগুলোতে চলমান ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে যাওয়ার ঘোষণা দেন চা-শ্রমিকেরা।
আজ রোববার সকালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া চা-বাগান, ভুরভুরিয়া চা-বাগান, খাইছড়া চা-বাগান ও জেরিন চা-বাগান ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন শ্রমিকেরা। কাঁধে ঝুলি আর মাথায় বাঁশের ছাতা নিয়ে সকাল সাড়ে আটটার দিকে কাজে বের হন তাঁরা। চা-বাগানের সরদারদের নেতৃত্বে শ্রমিকেরা বাগানে ভাগ হয়ে পাতা তোলার কাজ শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী চা-শ্রমিকদের পিঠের ঝুলি ভরে উঠতে শুরু করে চা–পাতায়।
নারী চা-শ্রমিক শ্যামলী ভুমিজ বলেন, ‘আমরা এত দিন পেটের দায়ে আন্দোলন করেছিলাম। বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। ১২০ টাকা দিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্ট হতো। আমাদের মজুরি মাত্র ১৪ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল বাগানমালিকেরা। আমরা সেটা মানিনি, আন্দোলন করেছি। আমাদের বিশ্বাস ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের কথা ভাববেন। তিনি একটি মানসম্মত মজুরি নির্ধারণ করবেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন আমরা ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজে যোগ দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের বিশ্বাস রেখেছেন।’
মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং ১৩ আগস্ট থেকে সারা দেশের চা-বাগানগুলোয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট করেছিলেন শ্রমিকেরা। দাবি আদায়ে গত কয়েক দিন উত্তাল ছিল চা-বাগানগুলো। আন্দোলন সফল করতে শ্রমিকদের সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করতে দেখা গেছে। এ প্রেক্ষাপটে গতকাল বিকেলে চা-বাগানের মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চা-বাগানের মালিক এম শাহ আলমের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বৈঠকে অংশ নেয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস সাংবাদিকদের কাছে সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরেন।
অনেক দিন ধরে আন্দোলনের কারণে চা–বাগানে কাজ করিনি। এখন চা–বাগানে এসে পাতাগুলোর জন্য মায়া হচ্ছে। মালিকপক্ষ যদি আগেই দাবি মেনে নিত, তাহলে এত আন্দোলন হতো না।
আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মজুরি নির্ধারণের পাশাপাশি বার্ষিক ছুটি, বেতনসহ উৎসব ছুটি আনুপাতিক হারে বাড়বে। অসুস্থতাজনিত ছুটি বাড়ানো হবে। চিকিৎসা ব্যয়ের চাঁদা মালিকপক্ষ বহন করবে। ভবিষ্য তহবিলে নিয়োগকর্তার চাঁদা আনুপাতিক হারে বাড়বে।’
এ ছাড়া ভর্তুকি মূল্যে রেশন–সুবিধা বাড়ানো হবে। চিকিৎসাসুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, চা-শ্রমিকদের পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ, গোচারণভূমি বাবদ ব্যয়, বিনা মূল্যে বসতবাড়ি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ শ্রমিককল্যাণ কর্মসূচি এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদন বাড়বে। সবকিছু মিলিয়ে দৈনিক মজুরি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকার মতো পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফিরতে বলেছেন বলে জানান মুখ্য সচিব। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চা-শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলে মজুরি বাড়াবেন, সেটা উনি করেছেন। কাল থেকে চা-শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বলেছেন তিনি। শিগগিরই চা-শ্রমিকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন।’
আজ সকালে শ্রীমঙ্গলের চা-বাগানে পার্বতী রবিদাস নামের এক শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ ছুটির দিন থাকা সত্ত্বেও সকাল সকাল কাজে বের হয়েছি। অনেক দিন ধরে আন্দোলনের কারণে চা–বাগানে কাজ করিনি। এখন চা–বাগানে এসে পাতাগুলোর জন্য মায়া হচ্ছে। মালিকপক্ষ যদি আগেই দাবি মেনে নিত, তাহলে এত আন্দোলন হতো না। এখন আমরা আমাদের সর্বোচ্চ কাজ দিয়ে চা–পাতাগুলো তুলে দেব। আমরা ১৭০ টাকা মজুরি পেয়ে খুশি। মজুরির পাশাপাশি আমাদের চিকিৎসা, রেশন, ঘরবাড়ির বিষয়গুলোর দিকে প্রধানমন্ত্রীর নজরদারি কামনা করি। আমরা ১৭০ টাকা মজুরির পাশাপাশি যদি অন্য সুযোগ-সুবিধাগুলো ভালো করে পাই, তাহলে আমাদের কষ্টের জীবনে একটু সুখ আসবে। আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোভাবে থাকতে পারব।’
বাংলাদেশ চা–শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মজুরি বৃদ্ধি পেয়ে ১৭০ টাকা হয়েছে। কাল রাত থেকেই আমরা বিভিন্ন ভ্যালি ও পঞ্চায়েত কমিটির সঙ্গে আলোচনা করেছি। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মেনে সবাই কাজে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছে। রোববার সাপ্তাহিক ছুটি থাকা সত্ত্বেও সবাই কাজে যোগ দিয়েছেন। চা–বাগানের কারখানাগুলো চালু হয়েছে। তবে কিছু চা–বাগানে চা–পাতা রাখার জায়গায় পুরোনো পাতা থেকে যাওয়ায় সেখানে শ্রমিকেরা আজ কাজে যোগ দেননি। আর ছুটির দিন থাকায় কিছু চা–বাগানে তাঁরা যাননি। তবে বেশির ভাগ চা–বাগানেই শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিয়েছেন। কাল সোমবার চা–বাগানে পুরোদমে কাজ হবে বলে আমরা মনে করি।’