জয়নালের কমলাবাগান এখন যেন একটি ‘পর্যটনকেন্দ্র’

ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের উত্তর বঠিনা গ্রামে জয়নাল আবেদীনের কমলাবাগান। গত মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

ঠাকুরগাঁও শহর থেকে উত্তরে ২০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গন ব্যারাজ। ব্যারাজের নালাগুলো ছড়িয়ে গেছে এদিক-ওদিক। সুনসান নীরব এ এলাকা এখন যেন একটি ‘পর্যটনকেন্দ্র’। সারা দিন সেখানে দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। মানুষের এই ভিড় জমে মূলত একটি কমলাবাগান ঘিরে। এ বাগানের মালিকের নাম জয়নাল আবেদীন।

জয়নাল আবেদীনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের উত্তর বঠিনা গ্রামে। ওই গ্রামে তিনি ছয় বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন কমলার বাগান। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পাটিয়াডাঙ্গী সড়ক ধরে এগিয়ে টাঙ্গন ব্যারাজে যাওয়ার পথের উত্তর দিকে চলে গেছে একটি নালা। নালা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই পড়ে জয়নাল আবেদীনের এই বাগান।

২৪ ডিসেম্বর বাগানটি ঘুরে দেখা যায়, সারি সারি গাছ। গাছে গাছে ঝুলছে কমলা আর মাল্টা। বেশির ভাগ ফলে পাক ধরেছে। ফলের ভারে অধিকাংশ গাছের ডালগুলো নুয়ে পড়েছে। ডাল ভেঙে যাওয়া ঠেকাতে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেক দেওয়া হয়েছে। বাগানের কর্মীরা গাছ থেকে ফল তোলায় ব্যস্ত। দর্শনার্থীরা বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেউ ছবি তুলেছেন, আবার কেউ ভিডিও করছেন। ফেরার সময় কেউ কেউ হাতে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাগানের তরতাজা কমলা আর মাল্টা।

জয়নাল আবেদীনের কমলাবাগানে হাজারো দর্শনার্থী আসেন, এর মধ্যে শিশুরাই বেশি। গত মঙ্গলবার দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের উত্তর বঠিনা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে জানান, তিনি কাস্টমসের কর্মকর্তা ছিলেন। এখন তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) রয়েছেন। ২০১৯ সালের কথা। তখন তিনি চুয়াডাঙ্গায় চাকরি করতেন। এক ছুটির দিনে ওই এলাকার একটি কমলাবাগানে বেড়াতে যান তিনি। গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা কমলা দেখে নিজেও বাগান গড়ে তোলায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরে সেখান থেকে ১৫০টি চায়না জাতের কমলা ও মাল্টার চারা সংগ্রহ করেন। এরপর ঠাকুরগাঁওয়ে এনে গড়ে তোলেন বাগান। মার্চে ফুল আসে। ফুলে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে গুটি (ফল) আসে। নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরে ফল পাকে। ২০২১ সালে গাছে ফল আসতে শুরু করে। সেবার তিনি কমলা ও মাল্টা মিলিয়ে ১০ মণ ফলন পেয়েছিলেন। সেসব ফল আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। এরপর ২০২২ সালে আড়াই লাখ টাকার ফল বিক্রি করেন। গত মৌসুমে তিনি ছয় লাখ টাকার কমলা ও মাল্টা বিক্রি করেন। বেশির ভাগ ফল বাগানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরাই কিনে নিয়ে যান।

আরও পড়ুন

জয়নাল আবেদীনের বাগানে প্রতি কেজি চায়না জাতের কমলা ২০০ টাকা, দার্জিলিং জাতের কমলা ও মাল্টা ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জয়নাল আবেদীন আশা করছেন, এবার তিনি ১৫ লাখ টাকার কমলা ও মাল্টা বিক্রি করতে পারবেন।

বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত লোকজন জানান, এ বাগানে এখন ২০০টি করে দার্জিলিং জাতের কমলা ও চায়না কমলার গাছ আছে। আর মাল্টার গাছ আছে ১৫০টি। গাছে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল আসে। ফুল আসার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে ফল আসে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ফল পাড়ার উপযোগী হয়।

বাগানে ঘুরতে এসে অনেক দর্শনার্থী কমলা-মাল্টার চারা পেতে খোঁজখবর নেন। উদ্যোক্তাদের কথা ভেবে জয়নাল আবেদীন নিজেই কলম করে চারা উৎপাদন করতে শুরু করেছেন। তাঁর বাগানের প্রতিটি মাল্টার চারা ২৫০ আর কমলার চারা ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জয়নাল আবেদীনের কমলাবাগানে দর্শনার্থীরা কেউ ছবি তুলছেন, আবার কেউ ভিডিও করছেন। ফেরার সময় কেউ কেউ হাতে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাগানের তরতাজা কমলা আর মাল্টা। গত মঙ্গলবার দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের উত্তর বঠিনা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

জয়নাল আবেদীন বলেন, মাল্টা চাষে খুব বেশি খরচ হয় না। প্রতিবছর বাগান পরিচর্যায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। ২০১৯ সালে তিনি নিজের এক বিঘা জমিতে কমলাবাগান গড়ে তোলেন। পরে পাঁচ বিঘা জমি লিজ নেন। তিন বছর ধরে তাঁর মাল্টাগাছে ভালো ফলন আসছে। সবশেষ দুই বছর ধরে তিনি সর্বোচ্চ ফলন পাচ্ছেন।

এখন তাঁর বাগানটি ‘পর্যটনকেন্দ্রে’ রূপ নিয়েছে জানিয়ে জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘শখ থেকেই কমলাবাগান করেছিলাম। এখন প্রতিদিন শত শত মানুষ বাগান দেখতে আসে। গত এক মাসে ৭০–৮০ হাজার দর্শনার্থী এসেছেন বাগানে। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। গাছ থেকে শিশুরা নিজেরাই ফল তুলে খেতে পারে। দর্শনার্থীরা যখন বাগানের প্রশংসা করেন, তখন আমার বেশ ভালো লাগে।’

আরও পড়ুন

কথা বলতে বলতে বাগানের প্রবেশপথে কয়েকজন শিক্ষার্থী আসেন। তাঁদের বাগানের কমলা-মাল্টা কেটে খাওয়ান জয়নাল আবেদীন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বিভিন্ন কথার জবাবও দেন তিনি।

সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘এখানে পর্যটনের তেমন জায়গা নেই। বাড়িতে বসে থেকে একঘেয়েমি চলে আসে। তাই এই কমলাবাগানে বেড়াতে এসেছি। এসে দেখলাম, এখানে অনেক মানুষের ভিড়। এখন এই কমলাবাগান পর্যটনকেন্দ্র হয়ে গেছে। গাছে ঝুলে থাকা কমলাগুলো দেখতে কী যে সুন্দর লাগছে, এটা ভাষায় বোঝানো যাবে না।’

নিজের হাতে গড়া বাগান পরিচর্যা করছেন জয়নাল আবেদীন। গত মঙ্গলবার দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের উত্তর বঠিনা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সুলতানা পারভীনের বাবার বাড়ি ঠাকুরগাঁও শহরে। তবে এখন তিনি বসবাস করেন রংপুরে। শীতের ছুটিতে বাবার বাড়িতে এসেছেন। বাড়ির ছোটদের আবদারে তাদের নিয়ে কমলাবাগানে এসেছেন তিনি। বাগানে এসে ছেলেমেয়েদের ছবি ‍তুলছিলেন। এক ফাঁকে তিনি বলেন, ‘এ যেন এক দার্জিলিং। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা কমলা-মাল্টার সঙ্গে নিজের ছবি তুলে রাখলাম।’

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছিলেন মাহফুজার রহমান। তিনি বলেন, ‘এ বাগান দেখে আমি বিমোহিত। এখানকার কমলা ও মাল্টা খেলাম। এই মাল্টা-কমলা বিদেশি মাল্টার মতোই স্বাদ।’

বাগান থেকে ফল তুলছিলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে সাগর ইসলাম বলেন, ‘আমি এবার এইচএসসি পাস করেছি। এখন খুব একটা পড়ার চাপ নেই। এই সময় বাগান পরিচর্যায় সাহায্য করি। এখানে যা পাই, তা দিয়ে পড়ালেখার খরচ চালানো যাবে পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতা করা যাচ্ছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মাল্টা-কমলা চাষ লাভজনক। জেলার মাটিতে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকায় সব ধরনের লেবুজাতীয় ফলন ভালো হচ্ছে। কমলা-মাল্টা চাষের এ সফলতা জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান তাঁরা।