চট্টগ্রামে ট্রাকচালকের চাকরি করতেন শাহিন মোল্লা (৩২)। সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিতে এসেছিলেন গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার উত্তর–পূর্ব ভান্ডারিয়া গ্রামে। নির্বাচন শেষে বাবাকে চিকিৎসক দেখিয়ে কর্মস্থলে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই গতকাল শনিবার মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে শাহিন মোল্লার। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পথে একই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে তাঁর বাবারও।
স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম থেকে রওনা দেন শাহিনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নাজমা আক্তার। রাত নয়টায় জানাজা শেষে বাবা-ছেলের লাশ বাড়িতে রাখা হয়। দাফনের আগে অপেক্ষা করা হয় শাহিন মোল্লার স্ত্রীর জন্য। রাত ১২টার দিকে নাজমা আক্তার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে শেষবারের মতো স্বামী ও শ্বশুরকে দেখেন। এ সময় বাড়িতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
আহাজারি করতে করতে নাজমা আক্তার বলছিলেন, ‘উনি (শাহিন) পৌরসভার নির্বাচনে ভোট দিতে বাড়ি এসেছিলেন। আসার সময় আমাকে বলেছিলেন, ভোটের পর চট্টগ্রামে ফিরবেন। বাড়িতে থাকার সময়ে প্রতিদিন মুঠোফোনে আমার খোঁজখবর নিতেন। আমাদের অনাগত সন্তান নিয়ে তাঁর কত উচ্ছ্বাস ছিল। আমাদের প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসতেছে। সন্তানের জন্য অনেক পরিকল্পনা ছিল। অথচ সেই সন্তান আর কোনো দিন বাবাকে দেখতে পাবে না। বাবাও সন্তানকে দেখে যেতে পারল না।’ নাজমা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার সন্তানের মতন এমন দুর্ভাগ্য কারও জীবনে যেন না আসে।’
গতকাল সকালে ‘বাসার স্মৃতি’ নামের যাত্রীবাহী একটি বাস ৬৫ থেকে ৭০ জন যাত্রী নিয়ে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালের দিকে যাচ্ছিল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন একটি পুকুরে পড়ে যায় বাসটি। এতে ১৭ জন নিহত ও ৩৪ জন আহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শাহিন মোল্লা, তাঁর বাবা আবদুস সালাম মোল্লাসহ (৬৫) আটজনের বাড়ি ভান্ডারিয়ায়।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শাহিন মোল্লা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মা–বাবার সংসারের খরচ দিতেন তিনি। এক সপ্তাহ আগে ভান্ডারিয়া পৌরসভার প্রথম নির্বাচন উপলক্ষে বাড়িতে যান শাহিন মোল্লা। স্ত্রী নাজমা আক্তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় তাঁকে চট্টগ্রামের ভাড়া বাড়িতে রেখে আসেন। দু–তিন দিনের মধ্যে তাঁর চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল।
চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে বাবা আবদুস সালাম মোল্লা হার্টে সমস্যার জন্য চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। এ জন্য গতকাল সকালে বরিশালে যাওয়ার জন্য বাবা ও ছোট ভাই রাসেল মোল্লাকে নিয়ে ভান্ডারিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বরিশালগামী একটি বাসে ওঠেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই বাবা-ছেলের প্রাণ গেল সড়কে।
রাসেল মোল্লা বলেন, ভান্ডারিয়া থেকে বাসটিতে ওঠার পর থেকে চালক তাঁর পাশের সিটে বসা যাত্রীর সঙ্গে গল্প করছিলেন। তিনি পথে বাস থামিয়ে অনেক যাত্রী তুলছিলেন। এ নিয়ে বাসের যাত্রীদের সঙ্গে চালকের ঝগড়া হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে পুকুরে পড়ে যায়।
শাহিন মোল্লার চাচাতো ভাই ফেরদৌস মোল্লা বলেন, শাহিন মোল্লা ভান্ডারিয়া পৌরসভার নির্বাচনে ভোট দিতে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি এসেছিলেন। অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসক দেখানোর পর তাঁর চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। শাহিন মোল্লার আয়ে পুরো সংসার চলত। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটির অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।