সিলেটে অস্ত্রবাজির ঘটনায় মামলা হয়নি, ধরা পড়েননি কেউ
১৮ জুলাই ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের অন্তত চারজনের হাতে ও ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল অন্তত ১০ জনের হাতে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে সিলেটে ১৭ দিনের ব্যবধানে দুই দফায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা। দুই দিনই অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি চালান। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। অস্ত্রধারীদের শনাক্তও করতে পারেনি পুলিশ।
ছাত্রলীগের দুজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই অস্ত্রের মহড়ায় নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তাঁদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। অস্ত্রধারীরাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে হামলা চালিয়েছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রায় সবার হাতেই দেশীয় অস্ত্র ছিল। এর বাইরে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। এ মহড়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
গত ৫ আগস্ট নগরের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন দেওয়ায় অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ এগোয়নি বলে জানিয়েছে মহানগর পুলিশের একটি সূত্র। তবে আন্দোলনের সময় গুলির ঘটনায় ভুক্তভোগীদের করা একাধিক মামলায় অস্ত্রধারীদের কাউকে কাউকে আসামি করা হয়েছে।
এই বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. জোবায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি অন্য কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এ ঘটনায় মামলা করতে চান, সেটাও নেওয়া হবে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রুদ্র সেন ও দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধি এ টি এম তুরাব নিহতের ঘটনায় সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুটি মামলা হয়েছে। ১৯ আগস্ট দুপুরে করা এসব মামলায় ১৮ জুলাই ও ৪ আগস্ট অস্ত্রধারীদের মিছিলে নেতৃত্বদানকারী জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের শীর্ষ চার নেতা এবং অস্ত্রধারী পীযূষ কান্তি দে-সহ অনেককেই আসামি করা হয়েছে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার পর থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, বারুতখানা, জেল রোড, চৌহাট্টা, কোর্ট পয়েন্ট, নয়াসড়ক, জল্লারপাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেওয়া শুরু করেন। এ সময় প্রায় সবার হাতেই রামদা, রড, হকিস্টিক, চাকু, লোহার পাইপ ও লাঠি দেখা গেছে। এর বাইরে অন্তত ১০ থেকে ১৫ জনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়।
এর আগে ১৮ জুলাই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে মদিনা মার্কেট, আখালিয়া, সুরমাগেট, তপোবন এলাকায় একইভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়া হয়। অস্ত্র নিয়ে মহড়ার ছবি প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। দুই দিনই মিছিল থেকে অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি চালান বলে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান।
দলীয় ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ১৮ জুলাই ও ৪ আগস্ট অস্ত্রসহ মিছিলে নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, মহানগরের সভাপতি কিশওয়ার জাহান, সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমদ, সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা এমদাদ রহমান প্রমুখ।
১৮ জুলাই ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের চার নেতা-কর্মীর হাতে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। তাঁদের একজন সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পীযূষ কান্তি দে। অন্যদের মাথায় হেলমেট থাকায় পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। ৪ আগস্ট মিছিলে ১০ থেকে ১৫ জনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। এঁদের মধ্যে অন্তত তিনজনের হাতে ছিল অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। তাঁদের মধ্যে লন্ডনপ্রবাসী মো. শিবলু আহম্মেদ, যুবলীগ নেতা সজল দাস অনিক ও জায়েদ আহমদ অন্যতম। অন্যদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এই বিষয়ে ছাত্রলীগের জেলা ও মহানগরের শীর্ষ চার নেতার বক্তব্য জানতে তাঁদের মুঠোফোনে ফোন করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ১৮ জুলাইয়ের ঘটনার বিষয়ে ওই দিন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁদের মিছিলে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছিলেন কি না, সেটা তাঁরা দেখেননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেটের সমন্বয়ক গোলাম মর্তুজা প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সিলেটে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করেছেন। অস্ত্রধারীদের চিহ্নিত করে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিটি ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে বিচার চান তিনি।