কুমিল্লায় ‘মরণফাঁদ’ হয়ে আছে শতাধিক অবৈধ রেলক্রসিং

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর এলাকায় সড়ক পারাপারের সময় ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দুমড়েমুচড়ে যাওয়া যন্ত্রাংশ পড়ে আছে রেললাইনের মাঝখানেফাইল ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লায় রেলপথে থাকা বৈধ রেলক্রসিংগুলোর চেয়ে অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা বেশি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, জেলার প্রায় ১২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা রেলপথে অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা শতাধিক। বছরের পর বছর ধরে এসব অবৈধ রেলক্রসিং মানুষের কাছে ‘মরণফাঁদে’ পরিণত হয়েছে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর এলাকায় একটি অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সাতজন নিহত হন।

কুমিল্লা রেলওয়ে সূত্র জানায়, কুমিল্লায় রেলওয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ধরা হয় লাকসাম রেলওয়ে জংশনে। কারণ, পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে লাকসাম রেলওয়ে জংশন। জেলার ১২০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে লাকসাম থেকে নোয়খালী পথে ১৭ কিলোমিটার এলাকা পড়েছে কুমিল্লা জেলার অংশে। লাকসাম থেকে চাঁদপুর রুটে পড়েছে ১১ কিলোমিটার। আর বাকি পুরোটাই পড়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে। এই বিশাল রেলপথ এলাকায় থাকা অবৈধ রেলক্রসিংগুলোতে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানি। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে মানুষকে।

কুমিল্লা রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী মজুমদার বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত বৈধ লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ৩৩। আর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ৩৮। যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেলগেট নেই, সেসব স্থানে সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের জন্য রেলওয়ের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে ২৩টি ক্রসিং বৈধ থাকলেও অবৈধ ৩৪টি। আর লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথে বৈধ লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ২২টি এবং অবৈধ ৪২। এ ছাড়া লাকসাম থেকে ফেনী রেলপথে বৈধ লেভেলক্রসিংয়ের চেয়ে অবৈধ ক্রসিংই বেশি।

লাকসাম রেলওয়ে থানার আওতাধীন এলাকা বিশাল। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর রেলস্টেশন থেকে ফেনীর ফাজিলপুর, লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথ এবং লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে লাকসামের চিতোষীর আগপর্যন্ত দেড় শ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ এলাকা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এই থানা থেকে। এই রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমরান হোসেন বলেন, চলাচলের সময় অসচেতনতার কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন। আবার রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কপথের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ রেলক্রসিংয়ে যান চলাচলে অসাবধানতার কারণে যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ির সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটছে। রেলওয়ের আইন অনুযায়ী রেললাইনে সব সময় ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকে। সে ক্ষেত্রে জনসাধারণকেই সচেতন হতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাকসাম রেলওয়ে জংশনে কর্মরত রেলের এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লা অংশের পুরোটাই ডাবল লাইন। এ কারণে অতীতের চেয়ে এই রেলপথে অনেক দ্রুত সময়ে ও গতিতে ট্রেন চলাচল করছে। বেশির ভাগ স্থানেই রেলক্রসিংগুলোতে কোনো গেট ও গেটম্যান নেই। প্রাণহানির বেশির ভাগই হয়েছে অবৈধ রেলক্রসিংয়ে।

পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘যেসব স্থানে অবৈধ লেভেলক্রসিংগুলো রয়েছে, ওই সড়কগুলোর বেশির ভাগই রেলওয়ের সঙ্গে সমন্বয় বা অনুমোদন ছাড়া করা হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোসহ স্থানীয় প্রশাসনকে প্রায় সময়ই বলেছি, রেলের অনুমোদন নিয়েই রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক নেওয়ার জন্য। কারণ, আমরা চাইলেই হুট করে ক্রসিংয়ের গেট নির্মাণ করতে পারি না। এখানে সার্বক্ষণিক জনবল নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ও আছে।’

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার বলেন, যেখানে রেলক্রসিং আছে, সেখানে রেলগেট নির্মাণ করা রেলওয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আর সরকারের যেসব দপ্তর সড়ক নির্মাণ করে তাদেরও উচিত কাজের সময় রেলওয়ের অনুমোদন নিয়েই রাস্তা করা। তাহলে এভাবে মানুষকে জীবন দিতে হয় না।