সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন গাছের ফল সংগ্রহ করেন তাঁরা

শাকবাড়িয়া নদীতে সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন গাছের ফল সংগ্রহ করছেন স্থানীয় নারী–পুরুষ। ১৪ সেপ্টেম্বর কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীরে
ছবি: ইমতিয়াজ উদ্দীন

সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় লোকালয়ে প্রতিদিন নদীর পানির সঙ্গে বনের ভেতর থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন গাছের ফল। খুলনার সুন্দরবন ঘেঁষে গড়ে ওঠা কয়রা উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবারের সদস্যরা এসব ফল সংগ্রহ করেন। তাঁরা এসব ফল রোদে শুকিয়ে জ্বালানির চাহিদা মেটান। এ কাজের ফলে বনভূমির বিস্তৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি উপকূলবর্তী এলাকায় ভাঙনের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী, কয়রা সদর, মহারাজপুর ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, নদীর জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা ফল কুড়িয়ে নিচ্ছে স্থানীয় নারী-পুরুষ ও শিশুরা। তাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। তাঁরা ফল কুড়িয়ে রাস্তার ওপর রোদে শুকাতে দিয়েছেন।

ভারতী মুন্ডা নামের এক নারী বলেন, ভেসে আসা ফলগুলোর ভেতর শাঁস থাকলে শুকাতে দেরি হয়, এ জন্য শাঁস বাদ দিয়ে ওপরের খোলস শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করেন। নিজেদের জ্বালানির প্রয়োজন মিটলে কিছু ফল বিক্রিও করেন। বনের বাইনগাছের ফল আগুনে পোড়ে না, সে জন্য তাঁরা এটি গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন।

সারা বছর ধরে সুন্দরবনের গরান, গেওয়া, খলিশা, সুন্দরী, পশুর, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের ফল জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে। এসব ফল গ্রামের দরিদ্র লোকজন জাল ও ঝুড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করেন।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারা বছর ধরে সুন্দরবনের গরান, গেওয়া, খলিশা, সুন্দরী, পশুর, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের ফল জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে। এসব ফল গ্রামের দরিদ্র লোকজন জাল ও ঝুড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করেন। একবার জোয়ারে একেকজন এক থেকে দেড় মণ ফল সংগ্রহ করতে পারেন।

কয়রা উপজেলা বন কর্মকর্তা প্রেমানন্দ রায় প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা ফল জ্বালানি বানিয়ে অনেকেই প্রাকৃতিক বনায়নে বাধার সৃষ্টি করছেন। সচেতনতার অভাবে অনেকেই এসব ফল নদী থেকে তুলে নিচ্ছেন। তবে অসংখ্যবার এমন কাজ না করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে।

আরও পড়ুন
নদীর পানিতে ভেসে আসা সুন্দরবনের গাছের ফল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাস্তার পাশে শুকানো হচ্ছে। সম্প্রতি কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের তীরে
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি কয়রার শাকবাড়িয়া নদী থেকে ঝুড়িভর্তি ফল নিয়ে রাস্তার কিনারে শুকাতে দিতে দেখা যায় কাকাটা গ্রামের মধ্যবয়সী নারী সুরভি মণ্ডলকে। আলাপকালে তিনি জানালেন, সারা বছরই এসব ফল সংগ্রহের কাজ চলে। এলাকায় জ্বালানির খুব সংকট। তাই প্রতিদিনই তাঁরা দল বেঁধে নদীর তীর থেকে ভেসে আসা সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছের ফল সংগ্রহ করেন। সুন্দরবনের ফল জ্বালানি ছাড়াও ছাগলের খাদ্য হিসেবে এলাকার মানুষ ব্যবহার করেন।

কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর তীরবর্তী এলাকার শ্রাবন্তী রানী, সূর্য মুন্ডা ও নিলিমা রানীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, সুন্দরবনের গাছের ফল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের কারণে সুন্দরবন ও চর বনায়নের অনেক ক্ষতি হয়। কিন্তু কী করবেন, জ্বালানি কাঠের অভাবে বাধ্য হয়ে তাঁরা ফল সংগ্রহ করেন। এসব ফল না তুলে নিলে চরে বড় বড় বনের সৃষ্টি হয়ে নদীভাঙন রোধ হতো।

আরও পড়ুন
নদীতে ভেসে আসা বিভিন্ন গাছের ফল সংগ্রহ করছেন নারীরা। সম্প্রতি কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীরে
ছবি: প্রথম আলো

কয়রার কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, সুন্দরবনের বিভিন্ন বৃক্ষের ফল নদীর পানিতে ভেসে লোকালয়ে এলে এলাকায় সাধারণ মানুষ না বুঝে তা সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। ফলগুলো সংরক্ষণ করা গেলে নদীর চরগুলোতে তৈরি হতো সবুজ বেষ্টনী। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, নদীভাঙন রোধ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নদীর চরে ভেসে আসা ফলগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা ফল সংগ্রহের ওপর সুস্পষ্ট কোনো বিধিনিষেধ নেই বলে জানালেন সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায়। তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবনের গাছ থেকে বিভিন্ন ফল নিচে পড়ে সুন্দরবনের মধ্যে কিছু চারা গজায় এবং অধিকাংশ ফল জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে লোকালয়ে নদীর কিনারে জমা হয়। এসব ফল দিয়ে উপকূলীয় মানুষের সাময়িক জ্বালানি সমস্যার সমাধান হলেও পরিবেশের জন্য এর ক্ষতির পরিমাণ বেশি। কেননা এসব ফল থেকে প্রাকৃতিকভাবে বিশাল এলাকায় বনায়ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন