আওয়ামী লীগের দুই নেতার দ্বন্দ্বে আতঙ্কে মুন্সিগঞ্জের আধারা ইউনিয়নের মানুষ

দুটি পক্ষ গত ৩৫ বছরে শতাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচজন। আহত হয়েছেন কয়েক শ মানুষ।

মুন্সিগঞ্জ জেলার মানচিত্র

আধিপত্য বিস্তার ও শক্তি প্রদর্শন নিয়ে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে দুই নেতার মধ্যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। প্রায়ই বাঁধছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এতে প্রাণ গেছে অন্তত পাঁচজনের। আহত হয়েছেন কয়েক শ মানুষ। ওই দুই নেতার কোন্দলের কারণে সব সময় এক ধরনের আতঙ্কে থাকতে হয় ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের বাসিন্দাদের।

পক্ষ দুটি হলো ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুরুজ মিয়া ও ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী হোসেন সরকার। সবশেষ ইউপি নির্বাচনের পর থেকে সুরুজ মিয়ার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নির্বাচনে পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল হক।

জন্মের পর থেকে এই এলাকায় মারামারি দেখছি। এগুলো আমরা আর নিতে পারছি না।
সালমা বেগম, স্থানীয় বাসিন্দা

সবশেষ গত বুধবার দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়ায়। এ সময় সুরুজ মিয়া পক্ষের আহাদুল, মনাসহ তিন-চারজনের একটি দলের হামলায় আলী হোসেন পক্ষের জয় মস্তান (২০), তিন পথচারী জুয়েল বেপারী (২৯), জুয়েলের ভাতিজি তাবাসসুম (৭ মাস), অটোরিকশাচালক জহিরুল ইসলাম (৩২) গুলিবিদ্ধ হন। নিজেদের ছোড়া গুলিতে সুরুজ মিয়া পক্ষেরই দুজন আহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন আলভি শিকদার (১৭) ও রাসেল শেখ (২৩)। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে জয় মস্তান ও তিন পথচারীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও পক্ষ দুটির অন্তত ১৫-২০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওই দুই নেতার কারণে ইউনিয়নের সোলারচর, আধারা ও বকুলতলা গ্রামে শান্তি নেই। মানুষের ঘরে ঘরে হামলা, মামলার আতঙ্ক বিরাজ করে। গত ৩৫ বছরে দুটি পক্ষ শতাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে সুরুজ ও আলী হোসেনের মধ্যে বিরোধ চলছে তরুণ বয়স থেকে। পক্ষ দুটির সংঘর্ষে ১৯৮৮ সালে সোলারচর এলাকার মজিবুর রহমান, ১৯৯৯ সালে দুলাল মাঝি, ২০০০ সালে আক্তার হোসেন, ২০১৩ সালে রুবেল হোসেন ও গত বছর ১৮ অক্টোবর বকুলতলা এলাকার মনির হোসেন মোল্লা নামের একজন সাধারণ পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

বুধবারের সংঘর্ষের পর থেকে ওই এলাকার পরিস্থিতি থমথমে। গতকাল সোলারচর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়,  এলাকার অধিকাংশ বাড়ি পুরুষশূন্য। বেশি ফাঁকা ছিল সুরুজ মিয়া পক্ষের লোকজনের বাড়িঘর। দুই পক্ষের যাঁরা এলাকায় আছেন, তাঁদের মধ্যে ছিল আতঙ্ক। জয় মস্তানের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তাঁর দাদা ৭০ বছর বয়সী সোহরাব মস্তান তালাবদ্ধ ঘরের দরজার সামনে বসে আছেন।

মানুষ দেখলেই নাতির অবস্থা বর্ণনা করে বিচার চাইছেন সোহরাব মস্তান। তিনি বলেন, ‘জয়ের অবস্থা খুব খারাপ। বুধবার সারা রাত আমরা হাসপাতালে ছিলাম। আজ (গতকাল) ভোরে বাড়িতে এসেছি। জয় চোখ খুলছে না। জয়ের কিছু হলে আমি নিজেও মরে যাব। সব আওয়ামী লীগের নেতাকে আসামি করে যাব।’

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুরুজ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ৩৫ বছর ধরে সুরুজ মিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করেছেন আলী হোসেন। আলী হোসেন বলেন, ‘আমি কখনো আগে থেকে ঝগড়া করতে যাইনি। সোলারচর গ্রামের শুরুতেই সুরুজ মিয়াদের বাড়ি। তাঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে তিন গ্রামের মানুষকে আসা–যাওয়া করতে হয়। কিছু হলেই সুরুজ ও তাঁর লোকেরা আমাদের লোকজনের ওপর জুলুম–অত্যাচার করে। নিজেদের আত্মরক্ষা করতে গিয়ে বারবার দ্বন্দ্ব–সংঘর্ষে জড়াতে হয়েছে।’

এসব ঘটনায় নিজের পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত এবং দুজন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেন আলী হোসেন। তিনি জানান, তাঁর পক্ষের লোকজনকে ২৫টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এখনো পাঁচটি মামলা চলমান আছে। তবে দ্বন্দ্বের অবসান চান আলী হোসেন। তাঁর দাবি, তিনি মীমাংসার জন্য এগিয়ে এলেও সুরুজ মিয়া মীমাংসা চান না। এর ফলে দ্বন্দ্ব চলমান রয়েছে।

সংঘর্ষ, হানাহানি, মারামারির ঘটনার পুনরাবৃত্তি চান না স্থানীয় মানুষজনও। সালমা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘জন্মের পর থেকে এই এলাকায় মারামারি দেখছি। এগুলো আমরা আর নিতে পারছি না। একেকটি ঘটনায় যে মা তার সন্তান হারাচ্ছে, যারা বাবা-ভাই হারাচ্ছে, তারাই বলতে পারবে তাদের কত কষ্ট। যারা দলাদলি করছে, তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। ক্ষতি হচ্ছে আমাদের। আমরা এই অবস্থার শেষ দেখতে চাই।’

আলী হোসেন ও সুরুজ মিয়াকে নিয়ে অতিষ্ঠ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন ভূইয়া। তিনি বলেন, ‘গত দুই-তিন বছরে ৮ থেকে ১০ বার দুটি পক্ষের সমস্যা সমাধান করেছি। স্থানীয় সংসদ সদস্যও কয়েকবার মীমাংসা করেছিলেন। সর্বশেষ কয়েক মাস আগে পুলিশ প্রশাসনও তাদের সমস্যা সমাধান করে। এরপরও তারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। তারা কারও কোনো কথা শুনছে না।’

বুধবারের ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য এর আগেও পুলিশ দুই পক্ষের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে বসেছিল। আবারও আমরা তাঁদের নিয়ে বসব।’

এদিকে গত পরশু দিনের ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে এবং আরও একটি মামলার আবেদন জমা পড়েছে।