ভাসানচরের পথে আরও ১৫২৭ রোহিঙ্গা
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরের পথে রওনা হয়েছে আরও ১ হাজার ৫২৭ রোহিঙ্গা। স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে বাসে করে কক্সবাজারের উখিয়া ডিগ্রি কলেজের মাঠে নেওয়া হয়। সেখান থেকে রাতে তারা চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রামে পৌঁছায়।
এ বিষয়ে আজ বুধবার সকালে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, ২৩তম দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে ১ হাজার ৫২৭ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে জড়ো করার পর রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ২২টি বাসযোগে তারা রওনা হয়। আজ সকালে নৌবাহিনীর জাহাজে তাদের ভাসানচরের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা রয়েছে। এর আগে একই প্রক্রিয়ায় কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া আশ্রয়শিবির থেকে ৩২ হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে যায়।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রম পরিচালনা করছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনী ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তায় দায়িত্বে নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক দিন পর আবার রোহিঙ্গার একটি দল ভাসানচরের পথে রওনা হয়েছে। আজ দুপুরের মধ্যে তাদের ভাসানচরে পৌঁছে যাওয়ার কথা রয়েছে।
উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবির ছেড়ে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাসানচর যাচ্ছেন রোহিঙ্গা নাগরিক রহিম উল্লাহ (৩৮)। ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রহিম উল্লাহ বলেন, এখানে (উখিয়ায়) অনেক সমস্যা। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা যখন-তখন ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, চাঁদা আদায় করে। খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণের ঘটনা লেগেই আছে। তা ছাড়া বর্ষায় পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে ঝুপড়িতে থাকতে হয়। শীতকালে আবার আগুন নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। ভাসানচরে এসব নেই। ভাসানচর নিয়ে শুরুতেই বিভিন্ন ধরনের দুর্নাম ছড়ানো হয়েছিল। কিন্তু ভাসানচর আশ্রয়শিবির অনেক নিরাপদ। সেখানকার থাকার ঘরগুলোও উন্নত। নিরাপত্তাব্যবস্থাও ভালো। তাই তাঁরা স্বেচ্ছায় ভাসানচর চলে যাচ্ছেন।
পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির সামনে বাসের অপেক্ষা করছিলেন মোহাম্মদ আলী হোসেন (৫৫)। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্য বাড়ছে। এখানে পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গারা বেশি রেশন পায়। তাই ভাসানচরে চলে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেখানেও (মিয়ানমারে) ফিরে যাওয়ার কোনো পথ দেখছেন না। ভাসানচরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
উখিয়ার বালুখালী (ক্যাম্প-১৫) আশ্রয়শিবির ছেড়ে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাসানচরের যাচ্ছেন মো. রফিকুল ইসলাম (৩৫)। তিনি বলেন, উখিয়ায় আশ্রয়শিবিরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের আরসা ও আরএসওর মধ্যে এমন কোনো দিন নেই খুনখারাবি ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে না। শিবিরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। মাদক বিক্রির পাশাপাশি ব্যবহারও বাড়ছে। কিশোরীরা নিরাপত্তাহীন, সব সময় অপহরণের আতঙ্কে থাকতে হয়। এ কারণে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে চলে যাচ্ছেন। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সময়-সুযোগ তৈরি হলে ফিরে যাবেন।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. এবাদুল্লাহ বলেন, ৯ মাস আগে তাঁর ভাই-ভাবিসহ পরিবারের ৯ জন ভাসানচরে গেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, সেখানে থাকার পরিবেশ ভালো। তাই পরিবারের পাঁচজনকে নিয়ে তিনিও যাচ্ছেন।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরের চাপ কমায় অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। সরকারি তথ্যমতে, নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই জায়গায় ১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এর আগে ২২ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে ৩২ হাজার রোহিঙ্গাকে। এর মধ্যে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় স্থানান্তর করা হয় ১ হাজার ৬৪২ জন, ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় ১ হাজার ৮০৪ জন, পরের বছর ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় দফায় স্থানান্তর করা হয়েছে ৩ হাজার ২৪২ জনকে। ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে মোট এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে রোহিঙ্গাদের বহনকারী ২২টি বাসচ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় পৌঁছার কথা। বাসগুলোয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি-বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকজন আছেন। তাঁদের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সও আছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা শুরু হলে পরের কয়েক মাসে অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।