প্রার্থী নিয়ে নেতাদের নির্লিপ্ততায় অস্বস্তিতে কর্মী-সমর্থকেরা 

আবুল খায়ের আবদুল্লাহ

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্লিপ্ততায় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে। কেন্দ্রে পাঠানো প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাব অগ্রাহ্য, মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান মেয়র ‘নিয়ন্ত্রিত’ মহানগর আওয়ামী লীগ এবং ৩০টি ওয়ার্ডের নেতাদের গা ছাড়া মনোভাবই অস্বস্তির অন্যতম কারণ। এ অবস্থায় ভোটের ফলাফলে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন কর্মী-সমর্থকেরা।

খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, দলীয় প্রার্থীকে কোণঠাসা করতেই মহানগরের বর্তমান নেতৃত্ব তাঁর পক্ষে উদাসীন মনোভাব দেখাচ্ছেন। নেতাদের এমন গা ছাড়া ভাব দলের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, প্রার্থী এখন নিজের মতো গণসংযোগ করছেন। তাঁদের রাজনৈতিক অভিভাবক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ অচিরেই বরিশালে আসবেন। এরপর যৌথ সভা করে তাঁরা সম্মিলিতভাবে মাঠে নামবেন।

১৫ এপ্রিল বরিশালে মেয়র পদে খায়ের আবদুল্লাহকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়র ও মনোনয়নবঞ্চিত সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর চাচা এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ভাই। এবারের নির্বাচনে খায়ের ও সাদিক আবদুল্লাহ ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন, যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন, বি এম কলেজের সাবেক ভিপি মঈন তুষার ও ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। সাদিক আবদুল্লাহ ছাড়া বাকি পাঁচজন খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে মাঠে নেমেছেন। সাদিক আবদুল্লাহ ঢাকায় আছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়ন পাওয়ার পর ২০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বরিশালে আসেন খায়ের আবদুল্লাহ। তখন শোভাযাত্রা করে তাঁকে বরিশালে বরণ করে নেন সমর্থকেরা। পরে সদর রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর নেপথ্যে ছিলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীরের সভাপতিত্বে সংবর্ধনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস দল মনোনীত প্রার্থীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। তবে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। নগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির নেতা-কর্মীদেরও সেখানে দেখা যায়নি।

সূত্র আরও জানায়, মনোনয়ন ঘোষণার তিন দিন পর ১৮ এপ্রিল নীরবতা ভেঙে খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন মনোনয়নবঞ্চিত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়ালি নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কাজ করার ঘোষণা দেন। তবে গত ১০ দিনে সেই ঘোষণার প্রতিফলন দেখা যায়নি। সংবর্ধনার পর নগরের বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাবেক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে খায়ের আবদুল্লাহ নিয়মিত মতবিনিময় করলেও মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের তাঁর সঙ্গে দেখা যায়নি। এতে প্রার্থী নিজেও অস্বস্তিতে আছেন বলে জানা গেছে।

খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগ সাদিক আবদুল্লাহর নিজের পছন্দের লোক দিয়ে গঠিত। ৩০টি ওয়ার্ডের কমিটিও তাঁর লোকদের দিয়ে করায় পুরোনো ও ত্যাগী অনেক নেতা-কর্মী ছিটকে পড়েছেন। বর্তমান কমিটির উচিত দলীয় প্রার্থীর পক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করা। এটা না হওয়া দুঃখজনক।

তবে সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গোলাম আব্বাস চৌধুরী বলেন, খায়ের আবদুল্লাহ সজ্জন ব্যক্তি। তাঁকে জয়ী করতে দলে বিভাজন নয়, প্রয়োজন ঐক্য। তাঁরা চান তিনি (খায়ের আবদুল্লাহ) তাঁর বড় ভাই হাসানাত আবদুল্লাহকে বরিশালে এনে নির্বাচনী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করুন। এতে নেতা-কর্মীরা বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের রাজনীতিতে হাসানাত আবদুল্লাহর প্রভাবের কারণে তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর সাদিক আবদুল্লাহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে মহানগর আওয়ামী লীগ থেকে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণপন্থী নেতা-কর্মীরা ছিটকে পড়েন। নিজের লোকদের নিয়ে মহানগর ও ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করে সাদিক আবদুল্লাহ নিজের প্রভাববলয় তৈরি করেন বলে অভিযোগ আছে। বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক মন্ত্রিত্ব পেলেও সাদিক আবদুল্লাহর প্রভাবে দলে ছিলেন কোণঠাসা। ছিটকে পড়া প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের সমর্থক নেতা-কর্মী ও পুরোনারা পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে ঘিরে আলাদা বলয় তৈরি করলেও তাঁরা এত দিন নীরব ছিলেন। খায়ের আবদুল্লাহ মনোনয়ন পাওয়ার পর তাঁরা নতুন করে উজ্জীবিত হচ্ছেন।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন বলেন, ‘সাদিক আবদুল্লাহ মনোনয়ন না পাওয়ায় বর্তমান কমিটির অনেকেই নির্বাচনী কাজে এখন আর আগ্রহী নন বলেই মনে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।’ তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, ‌‘প্রার্থীকে আমরা বরণ করেছি, সংবর্ধনা দিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক হাসানাত আবদুল্লাহ অচিরেই বরিশাল আসবেন। এরপর মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ যৌথ সভা করে সম্মিলিতভাবে মাঠে নামবে।’ দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঢাকায় খুবই ব্যস্ততার মধ্যে আছি। এ ব্যাপারে পরে কথা বলব।’