হাকালুকি হাওরপারে ‘আফাল’ আতঙ্ক

বাঁশ, কচুরিপানা দিয়ে আফাল থেকে ঘরের মাটির ভিটা, বেড়া টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন হাকালুকি হাওরপারের বাসিন্দারা। শনিবার মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকিপারের তালিমপুর ইউনিয়নের মুর্শিবাদকুরা গ্রামেছবি: প্রথম আলো

পানির সঙ্গে বসবাসে অভ্যস্ত হাকালুকি হাওরপারের মানুষেরা। হাওরে পানি বাড়লে আশপাশের গ্রামগুলোর খালে-বিলে পানি ঢোকে, বাড়ির আশপাশ থইথই করে পানিতে। এতে যতটুকু সমস্যা হয়, গ্রামের মানুষ তা স্বাভাবিকভাবে মোকাবিলা করেই বর্ষা মৌসুম পার করেন। সে পানি একটা সময় নেমেও যায়। কিন্তু পানি যখন বাড়তে বাড়তে বন্যায় রূপ নিয়ে বাড়িঘরে ওঠে, তখন দুর্ভোগটা তখন অনেক বেড়ে যায়।

গত কয়েক বছর ধরে বন্যায় দুর্ভোগময় পরিস্থিতিতে পড়েছেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাকালুকিপারের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। হাওরের উত্তাল ঢেউ, যা স্থানীয়দের কাছে ‘আফাল’ নামে পরিচিত; তা এখন বড় আতঙ্ক হয়ে উঠেছে কাঁচা ঘর, মাটির ভিটার ঘরবাড়ির মানুষদের কাছে। আছড়ে পড়া তীব্র ঢেউয়ের মুখে ঘরগুলো টিকিয়ে রাখা অনেকের কাছেই কঠিন হয়ে পড়েছে। কচুরিপানাসহ বাঁশের বেড়া তৈরি করে ভিটা, কাঁচাঘর টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

হাওরপারের তালিমপুর ইউনিয়নের মুর্শিবাদকুরা গ্রামের বাসিন্দা আছার উদ্দিন (৬১) প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো বছরই বন্যায় ঘর ছাড়ছি না। কষ্ট করি ঘরও রইছি। গরু-বাছুর লইয়া কই যাইতাম? ঘরে থাকিয়াউ ঘর রক্ষা করা যায় না। আফালে নেরগি (ঢেউয়ে নিয়ে যাচ্ছে)।’ তিনি বলেন, ‘কত পেনা দিছি (কচুরিপানা দিয়েছি)। এরপরও ঘরর মাটি নেয়গি (নিয়ে যায়)। এখন আশ্রয়কেন্দ্র থাকলে আর আইয়া (এসে) ঘর পাইলাম নানে (পেতাম না)। তাই কষ্ট করি ঘর টিকাইরাম। পরিবার, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ আছি। আমরার লড়াই আমরারেউ করা লাগের।’

আছার উদ্দিন বলেন, ‘হাওরে যারা আমরা থাকি। আমরার বন্যা অইলে (হলে) বেশি কষ্ট অয় (হয়) আফালে। এই আফাল রাতে বেশি অয়। যখন বাতাস ওঠে, আর রাতে ইঞ্জিন নৌকা চলে, তখন আফাল একটার পর একটা আইয়া (এসে) ভিটার মধ্যে পড়ে। মনে অয় এই বুঝি ঘর ভাসাই লইয়া গেল (ভাসিয়ে নিয়ে গেল)। ইবার (এবার) ঘরের অনেক ক্ষতি অইছে (হয়েছে)। ভিটার অনেক মাটি নিছেগি (নিয়ে গেছে)। বন্যায় কষ্ট কররাম। বন্যা শেষ অইলে আরও কষ্ট করা লাগব।’

মুর্শিবাদকুরা গ্রামের বাসিন্দা মরিয়ম বিবি বলেন, ‘পানিবন্দী আছি। দিন আমরার যেমন-তেমন কাটে। রাতে আতঙ্কে থাকি। ঘুম আয় (আসে) না। রাতে আফাল ওঠে বেশি। আর সাপের ডর (ভয়) তো আছেই।’ আরও অনেকের মতো ঘরের আশপাশ আফাল (ঢেউ) থেকে বাঁচাতে বাঁশ ও কচুরিপানা দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করেছেন তিনি।

এ রকম পরিস্থিতি শুধু তাঁদেরই না। হাওরপারের বড়ময়দান গ্রামের জিলই বেগম, ফখর উদ্দিন, মুর্শিবাদকুরা গ্রামের চিমিনা বেগম, মারজানা বেগম জানিয়েছেন, তাঁদের সবার বাড়িঘরই আফালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, হাকালুকি হাওরে বর্ষাকালে এমনিতেই বিশাল ঢেউ ওঠে। কিন্তু এই ঢেউ সরাসরি তেমন ক্ষতি করতে পারে না। হাওরপারের মানুষ এ রকম পানি ও আফালের সঙ্গে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তবে বন্যার সময় তারা বিপদে পড়েন। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় সেই ঢেউ সরাসরি ঘরে আছড়ে পড়ে। এতে কাঁচা বাড়িঘরের মাটির ভিটা, মাটির বেড়া ভেঙে যায় ও ভেসে যায়। এ কারণে আতঙ্ক আর ভোগান্তির মধ্যে দিন কাটে তাঁদের।

বন্যার সময় হাওরের বড় বড় ঢেউ সরাসরি আছড়ে পড়ে এসব বসতঘরে। মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকিপারের তালিমপুর ইউনিয়নের মুর্শিবাদকুরা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওরপারের মুর্শিবাদকুরা, বড়ময়দান, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়াসহ বেশির ভাগ গ্রামেই আফালের আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত ১৫ জুন থেকে হাকালুকি হাওরপারে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত দুই-তিন দিন ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু সোমবার রাতে বৃষ্টি হওয়ায় আবার পানি কিছুটা বেড়েছে।

তালিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস প্রথম আলোকে বলেন, এবার আফাল এখনো তুলনামূলক কম। সোমবার বিকেলে বাতাসের কারণে কিছুটা ঢেউ দেখা গেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে বাতাস দিলেই আফাল ওঠে। তখন মাটির ঘর, দেয়াল ধসে পড়ে। তিনি বলেন, তালিমপুর ইউনিয়নের প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ পানিবন্দী। অনেকে আছেন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে থাকছেন। এক হাত পানি কমলে মানুষ চলাচলের সুযোগ পেত।