দিঘির জলে পাখির কলরব
চারদিকে সবুজ বৃক্ষরাজির বেষ্টনী। এর মধ্যেই ৪৩ একর আয়তনের বিশাল এক দিঘি। দল বেঁধে পাখিরা দিঘির জলে নেমে কেউ খাবার খুঁজছে, কেউ–বা জলে ভেসে থাকা পদ্ম পাতায় বসে রোদ পোহাচ্ছে। মানুষের সাড়াশব্দ পেলেই তারা ডানা মেলে উড়াল দিচ্ছে। এভাবেই অতিথি ও দেশীয় পাখির কলরবে মুখর থাকছে নওগাঁর ধামইরহাটের আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত এই জলাশয়।
আলতাদীঘির জাতীয় উদ্যানের সবুজঘেরা প্রকৃতি আর শীতে আসা অতিথি পাখি দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা শত শত মানুষ ভিড় করছেন।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান। ১৭ দশমিক ৩৪ হেক্টর আয়তনের সেই উদ্যানের প্রায় মাঝখানে আলতাদীঘি নামে একটি দিঘি। এই দিঘির চারপাশে বিশাল বনভূমি। ২০১১ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আলতাদীঘি বন এলাকাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১০-১২ বছর ধরে সাইবেরিয়াসহ বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে এই দিঘিতে পাখি আসছে। এ দিঘিকে পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে বন বিভাগ।
বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আলতাদীঘি উদ্যানের আশপাশের এলাকার মানুষজনের কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর শীতকালে আলতাদীঘিতে পাখিদের বিচরণ বেড়ে যায়। এবার গত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশীয় পাখির পাশাপাশি নানা জাতের পরিযায়ী পাখির উপস্থিতিতে সরব দিঘি, উদ্যান ও এর আশপাশের এলাকা। ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ থাকবে।
সম্প্রতি আলতাদীঘিতে গিয়ে প্রথম দর্শনে মনে হয় যেন হাঁসের খামার। কাছে যেতেই ভুল ভাঙে। মানুষের উপস্থিতি টের পেতেই পাখিগুলো ভয় পেয়ে উড়াল দিচ্ছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা এসব পাখিকে বালিহাঁস, সরালি, পাতিসরালি, ঝুটিহাঁস, চকাচকিসহ বিভিন্ন নামে ডাকেন। পরিযায়ী পাখি ছাড়াও এই দিঘিতে শামুকখোল, পানকৌড়ি, ছন্নিহাঁস ও বকের দেখা মিলল।
দিঘির চারপাশ ঘুরে ঘুরে পাখি দেখছিলেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দর্শনার্থীরা। নওগাঁ সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজহারুল ইসলাম এসেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। আজহারুল বলেন, ‘নিজেদের এলাকায় পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য দেখে খুব ভালো লাগছে। বিশাল উদ্যানে নানা ধরনের গাছপালা, বড় বড় উইয়ের ঢিবি আর দিঘির জলে পাখিদের কলকাকলি দেখে খুব ভালো লাগছে।’
তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বন বিভাগ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে দিঘির পরিবেশ। গাছের পাতা পড়ে দূষিত হচ্ছে দিঘির পানি। ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসা পাখিদের উপস্থিতি কম লক্ষ করা গেছে। যে পাখিগুলো এসেছে, সেগুলো দিঘির বিষাক্ত পানিতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারছে না। এমন অবস্থায় দীঘি খননসহ পানি পরিষ্কার করা না হলে আগামী দিনে পাখিদের বিচরণ আরও কমতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতন মানুষ।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) নওগাঁ জেলা কমিটির সভাপতি হেফজুল ইসলাম বলেন, চলতি শীত মৌসুমে সারা দেশেই পরিযায়ী পাখির বিচরণ কমেছে। নওগাঁর আলতাদীঘি অভয়াশ্রমেও গত বছরের তুলনায় এবার পাখির বিচরণ কম দেখা গেছে। নানা কারণে পাখি আসা কমেছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো দিঘির জল দূষিত হওয়া, বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ ও আহরণ করা, দিঘির চারপাশ থেকে মিশ্র প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা, জনগণের সচেতনতার অভাব ও দর্শনার্থীদের উচ্চস্বরে গান-বাজনা ও মাইক বাজানো। এসব সমস্যা দূর করা গেলে আবারও আগের মতো পাখির বিচরণ হবে।
উপজেলা বন বিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি পেলে দিঘির খননকাজ শুরু করা হবে। দিঘির চারপাশের গাছগুলো পুরোনো হওয়ায় এবং দিঘির জলে গাছের পাতা পড়ে পানি দূষিত হওয়ার কারণে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। এখন দিঘির চারপাশে শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো হবে। এছাড়া আলতাদীঘি উদ্যানে ঘুরতে আসা দর্শকদের দিঘির চারপাশে বসার স্থান করা হবে। আলতাদীঘিকে একটি ভালো পর্যটনকেন্দ্রে রূপ দেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে।