পালপাড়ায় হামলা-ভাঙচুর, সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্কে বাসিন্দারা

মাটির তৈরি পাট ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বামুনিয়া গ্রামেছবি: সোয়েল রানা

৫ আগস্ট রাত সাড়ে নয়টা। রাতের খাবার খেয়ে লাল মোহন পাল (৫৫) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ দোতলা বাড়ির ফটকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। হইচই করে হাজির হন ১৫০-২০০ জন। তাঁদের হাতে লাঠিসোঁটাসহ দেশি ধারালো অস্ত্র। তাঁরা পেট্রোল ঢেলে আগুন দেন বাড়ির ফটকে। এরপর বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন লাল মোহন। তাঁর বাড়ি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের বামুনিয়া পালপাড়ায়। ওই রাতে পালপাড়ার অন্তত ১০টি বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুট করা হয়। সংখ্যালঘু এক কৃষকের গোয়ালঘর থেকে লুট করা হয় চারটি গরু। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পরও আতঙ্কে আছেন পালপাড়ার বাসিন্দারা।

লাল মোহন পাল বলেন, ‘স্যানেটারি রিং স্ল্যাব বসানোর উপার্জনে সংসার চলে। রাজনীতি বুঝি না। দ্যাশত গন্ডগোল। সেদিন (৫ আগস্ট) কামকাজ শ্যাষে সাঝবেলাতেই বাড়িত ফিরচি। রাতের খাবার খায়্যা শোয়ার ঘরত যামো, এমন সময় মানুষের শোরগোল। হঠাৎ বাড়ির গেটত থ্যাকে দাউ দাউ আগুনের হলকা। প্রাচীর টপকে কোনো রকমে বাড়ির বাইরে পালিয়ে জানডা বাঁচাইছি।’

উপজেলার পীরগাছা বাজারের কিছুটা দূরে বামুনিয়া গ্রামের অবস্থান। গত শনিবার ওই গ্রামের পালপাড়ার প্রবেশমুখে পৌঁছাতেই চোখে পড়ে উঠানজুড়ে ইটখোলা ও পোড়ামাটির মৃৎশিল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গ্রামজুড়ে সুনসান পরিবেশ। দেখা মিলল কয়েকজন তরুণ-যুবকের, নারীদের জটলা। সবার চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

পালপাড়ায় বসতবাড়িতে হামলা–ভাঙুচর করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বামুনিয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পালপাড়ার লোকজন জানান, এ পাড়ায় ৬৫টি পাল পরিবারের বসবাস। অধিকাংশই মাটির তৈজস ও প্রতিমা তৈরি করে কোনো রকমে সংসার চালান। কেউ কেউ ব্যবসা ও কৃষিকাজ করেন। এ পাড়ায় কেউ রাজনীতির সঙ্গে তেমন জড়িত নন। তবুও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর রাতে পালপাড়ায় হামলা হয়। বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মাটির তৈজস ভাঙচুর করা হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় খড়ের গাদা ও ভ্যান গাড়ি। সেই থেকে আতঙ্ক–উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে পালপাড়ায়। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন পালপাড়াবাসী। পাড়ার পুরুষেরা রাত জেগে দল বেঁধে পাহারা দেন।

এ সম্পর্কে গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশিক ইকবাল বলেন, ‘৫ আগস্ট পুলিশ বাহিনী নিজেই নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিল। এ কারণে বামুনিয়া পালপাড়ায় দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর পালপাড়ায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছি। দু-তিনজনের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং আতঙ্ক কাটাতে রাতে সেখানে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

৫ আগস্ট রাতে পালপাড়ার অন্তত ১০টি বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুট করা হয়। সংখ্যালঘু এক কৃষকের গোয়ালঘর থেকে লুট করা হয় চারটি গরু।

পালপাড়ার বাসিন্দা অক্ষয় পাল বলেন, ‘সারা দিন খাটুনি করে বাড়িত ফিরি। রাতে ঘুম নেই। লাঠি হাতে দল বেঁধে পাহারা দিতে যাই। আর বউ-ঝিগেরে কোনো রকমে দিনটা কেটে যায়। সন্ধ্যা নামলেই বাড়তে থাকে আতঙ্ক।’

পালপাড়ার বাসিন্দা প্রশান্ত চন্দ্র পাল (৪০) জানান, ওই রাতে (৫ আগস্ট) খাবার খেয়ে সবে ঘুমানোর প্রস্ততি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ ১৫০-২০০ জন বসতবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর শুরু করেন। গোয়ালে থাকা চারটি গাভি লুট করে নিয়ে যান। হামলাকারী সবারই মুখচেনা। তিন দিন পর বিএনপির নেতাদের মধ্যস্থতায় তিনটা গাভি ফেরত পেয়েছেন।
হামলাকারীদের পরিচয় জানতে চাইলে প্রশান্ত চন্দ্র পাল বলেন, ‘সগলি মুখচেনা। এরা দ্যাশত যখন যে সরকার আসে, তখন তাদের লোক হয়্যা যায়। আগে আওয়ামী লীগ নেতাগেরে সঙ্গে ঘুরিচ্চিল, এখন হয়্যা গ্যাচে বিএনপি।’

হামলাকারীরা আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করে সাত লাখ টাকার বস্তা লুট করেছে। দোকানের মেশিনও নিয়ে গেছে। এখন ব্যবসা করব কীভাবে?
আপন চন্দ্র পাল, ব্যবসায়ী ও পালপাড়ার বাসিন্দা

পালপাড়া মোড়ে চট ও সিনথেটিক বস্তা বিক্রির দোকান ছিল পালপাড়ার ব্যবসায়ী আপন চন্দ্র পালের। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করে সাত লাখ টাকার বস্তা লুট করেছে। দোকানের মেশিনও নিয়ে গেছে। এখন ব্যবসা করব কীভাবে?’

হামলাকারীরা স্বপন চন্দ্র পাল ও শ্যামল চন্দ্র পালের মুদিদোকানে হামলা চালিয়ে কয়েক লাখ টাকার মালামাল লুট করেছে। এ ছাড়া অক্ষয় পাল, রিপন পাল ও কমল চন্দ্র পালের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর করেছে।

হামলার শিকার রিপন পালের স্ত্রী বিউটি রানী পাল বলেন, ‘বিয়ার সময় বাবার বাড়ি থ্যাকে দেওয়া তিন ভরি সোনার গয়না ছিল। ঘরের আলমারি ভাঙে টাকাপয়সা, গয়না—সব লুট করচে।’

হামলার পর থেকে রিপন পালের বৃদ্ধা মা সুনীতি বালা রাতে ঘুমাতে পারছেন না। তিনি বলেন, পালপাড়ার ঘরে ঘরে আতঙ্ক। হামলার ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে। মাটি পোড়ানোর উপার্জনে হামাকেরে প্যাট চলে। সরকারে কে থাকল, কে গেল হামাকেরে এত কিছু জানার দরকার পড়ে না। হামাকেরে বাড়িঘরত কেন আগুন দিল?’