প্রকৃতি-পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জে মণ্ডপে পূজার আয়োজন
নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজার গোপীনাথ জিউর আখড়া। ৬৭ বছরের পুরোনো এই আখড়ায় দুর্গাপূজার মণ্ডপ সাজানো হয়েছে পরিবেশবান্ধব শীতল পাটি, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী দিয়ে। মাটির তৈরি প্রতিমায় শাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে শীতল পাটি। প্রতিমার অলংকার ও মাথার মুকুটে মাটি ও কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। মণ্ডপের তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে বাঁশ ও চাটাই দিয়ে। লোক ও কারুশিল্পের নান্দনিক কারুকাজে তৈরি পূজামণ্ডপে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা।
আজ শনিবার দুপুরে এই মণ্ডপ পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায় প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ রক্ষায় প্রকৃতি ও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে এবারের পূজামণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে। মণ্ডপে বৈচিত্র্যপূর্ণ সাজসজ্জা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মণ্ডপ তৈরিতে তাঁদের এই থিম পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে উৎসাহিত করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
২০ বছর ধরে পূজার আয়োজন করছে শহরের টানবাজার সাহাপাড়া এলাকার পূজা উদ্যাপন কমিটি। পূজামণ্ডপ ও প্রাচীরে তারা ব্যবহার করেছেন রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে যাওয়া আড়াই শর বেশি বেনারসি ও কাতান শাড়ি। পুড়ে যাওয়া শাড়ির ভালো অংশটুকু কেটে তা দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছেন তাঁরা। পূজামণ্ডপের প্রাচীরে কালো কাপড় ও শোলা কাঠি ব্যবহার করেছেন তাঁরা।
আয়োজক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সুমন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই ব্যবসায়ীদের প্রতি শোকের প্রতীক হিসেবে মণ্ডপে কালো কাপড়ের ঘের দেওয়া হয়েছে। পুড়ে যাওয়া শাড়ি ব্যবহার করে সাজসজ্জায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মা দুর্গা ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ১০ জন দেবতার কাছ থেকে গ্রহণ করছেন। মা দুর্গা কোন দেবতার কাছ থেকে কী অস্ত্র গ্রহণ করছেন, সেটি আমরা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।’
শত বছরের পুরোনো শহরের আমলাপাড়া পূজামণ্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। গাছের গুঁড়ি ছোট চাকতি আকারে কেটে তা লাগিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মণ্ডপের ছাদ তৈরি করা হয়েছে।
এবারের পূজামণ্ডপগুলোতে বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দর্শনার্থী আপ্পি সাহা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মণ্ডপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, বাঁশ ও বেত। প্রতিমার গয়নায় অভিনবত্ব আনা হয়েছে।
পূজামণ্ডপ দেখতে স্বজনদের সঙ্গে বের হয়েছেন শহরের আমলপাড়া এলাকার বাসিন্দা স্বর্ণা দে। তিনি বলেন, এবার পূজামণ্ডপের আয়োজন সুন্দর ও ভালো হয়েছে। গত বছর পূজার আয়োজন আরও বেশি জমকালো ছিল বলে তিনি জানান।
নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় এবার ২২৪টি মণ্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। গত বছর থেকে এবার ১২টির বেশি মণ্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। মণ্ডপগুলোতে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের পাশাপাশি বর্ণিল আলোকসজ্জা করা হয়েছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দর্শনার্থীরা মণ্ডপগুলোতে ভিড় করছেন।
অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ঋষিপাড়া এলাকায় কাউন্সিলর মাকছুদুল আলমের সহযোগিতায় দুই বছর ধরে দলিত সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার আয়োজন করা হচ্ছে। পূজা উপলক্ষে সহস্রাধিক দুস্থ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হাতে নতুন কাপড় তুলে দেওয়া হয়েছে।
কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দলিত সম্প্রদায়ের নিজস্ব উদ্যোগে দুর্গাপূজার আয়োজনের ব্যবস্থা ছিল না। সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের অনুদানে পূজা আয়োজন করা হয়েছে। সম্প্রীতির শহর নারায়ণগঞ্জ, এটাই তার প্রমাণ।
নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সমস্যা দেখছেন না বলে জানিয়েছেন জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে পূজার আয়োজন ভালো হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, পূজা ঘিরে কেউ যাতে নাশকতা করতে না পারে, সে জন্য মণ্ডপগুলোয় ইউনিফর্ম পরা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ তৎপর আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ যাতে গুজব ছড়াতে না পারে, সে কারণে নজরদারি করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শারদীয় দুর্গাপূজা সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।