স্বপ্নপূরণে খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা

ওরা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তবু এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সব বাধা অতিক্রম করে জিপিএ–৫ পেয়েছে।

পাহাড়ি রাস্তায় তেমন যানবাহন চলে না। বর্ষার সময় রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে গেলে হেঁটে চলাও কষ্টকর হয়ে ওঠে। এমন পাহাড়ি পথ ধরেই তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে আসা-যাওয়া করত হুমায়রা বেগম। দুপুরের খাওয়াও হতো না। টাকার অভাবে প্রাইভেটও পড়া হয়নি। ঘরে ছিল না পড়াশোনার পরিবেশ। এমন নানা সংকট মোকাবিলা করেও এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বালুখালীর আজুখাইয়া গ্রামের মেয়ে হুমায়রা।

উচ্চশিক্ষা নিতে হলে হুমায়রাকে এখন ৬০ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার সরকারি কলেজে ভর্তি হতে হবে; কিন্তু কলেজে ভর্তি এবং শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ জোগানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় তার পরিবার। হুমায়রার মতোই এসএসসিতে ভালো ফল করেও কলেজে পড়ার খরচের দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে ঢাকার নবাবগঞ্জের জিয়াদ আহমেদ, শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার মারিয়া জান্নাত ও কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার আঁখি আক্তার।

বাবার ইচ্ছাপূরণের চেষ্টায় জিয়াদ

জিয়াদ আহমেদ ঢাকার নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় জিয়াদ আহমেদের বাবা মো. স্বপন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সংসারের হাল ধরেন মা নার্গিস বেগম। তিনি সেলাইয়ের কাজ করে বড় মেয়ে স্বর্ণা ইসলাম ও ছেলে জিয়াদের পড়ালেখার খরচ চালান। নানা রোগশোকে তিনিও এখন ক্লান্ত।

জিয়াদের পরিবার নবাবগঞ্জের কাশিমপুর এলাকায় থাকে। বোন স্বর্ণা ইসলাম দোহার নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি টিউশনি করিয়ে সংসার ও ভাইয়ের শিক্ষার খরচ বহন করছেন। স্বর্ণা বলেন, শত বাধা পেরিয়ে ভাইয়ের ইচ্ছাপূরণে পাশে থাকতে চান স্বর্ণা। মায়ের চিকিৎসার খরচ, পরিবারের ভরণপোষণ ও বাসাভাড়া মিটিয়ে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম যেন তাঁর কাছে এক যুদ্ধের শামিল।

জিয়াদ আহমেদ বলে, বোনই তাকে সব বিষয়ে পড়তে সাহায্য করেন। সারা দিন বই পড়ে অবসর সময়ে অসুস্থ মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করেছেন। বাবার ইচ্ছা ছিল, তাকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন; কিন্তু বাবা নেই। সেই ইচ্ছা কীভাবে পূরণ হবে?

নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান বলেন, জিয়াদ খুবই মেধাবী। সে ভালো কিছু করতে পারবে।

স্কুলের বেতন দিতে পারত না মারিয়া

নালিতাবাড়ী উপজেলার সমশ্চূড়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখা থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে মারিয়া জান্নাত। তার বাবা হযরত আলী কৃষিশ্রমিক। মা জহুরা খাতুন গৃহিণী। খরচ বাঁচাতে বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে প্রতিদিন হেঁটেই যাতায়াত করত মারিয়া। দরিদ্র বাবার পক্ষে বিদ্যালয়ের বেতনও ঠিকমতো দেওয়া সম্ভব হতো না।

মারিয়াদের বাড়ি উপজেলার শেখেরকুড়া গ্রামে। তার মা জহুরা খাতুন বলেন, ‘টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পরীক্ষার আগের চার মাস মারিয়ার পড়াশোনা প্রায় বন্ধ ছিল। সংসার আর মেয়ের লেহাপড়ার খরচ চালাতে গিয়া সুদে টাকা নিতে হয়েছে।’ তিনি জানান, অভাবের কারণে মেয়েকে তিনি মানবিক বিভাগে পড়তে বলেছিলেন; কিন্তু মেয়ে তো মানে না, কান্না করে।

মারিয়া জান্নাত বলে, ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায় সে। সমশ্চূড়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ছাইফুল ইসলাম বলেন, আর্থিক সহযোগিতা পেলে লেখাপড়ায় মেয়েটা ভালো করবে।

স্কুলে একমাত্র হুমায়রাই জিপিএ-৫ পেয়েছে

কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং হাইস্কুল থেকে এবার ২২১ জন এসএসসি পরীক্ষা দেয়। তাদের মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ির বালুখালীর আজুখাইয়া গ্রামের হুমায়রা বেগমই একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হুমায়রার বাবা আলীম উদ্দিন একসময় বর্গাজমিতে ধান ও সবজির চাষ করে আট সদস্যের সংসার চালাতেন। কয়েক বছর ধরে বাড়ির পাশে চা-দোকান খুলে সংসার এবং চার ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানোর চেষ্টা করছেন আলীম উদ্দিন। তিনি বলেন, দোকানে বেচাবিক্রি হলে দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। বিক্রি না হলে দুঃখ-কষ্ট বাড়ে। তখন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ টানতে অন্যের কাছে হাত পাততে হয়।

হুমায়রার ইচ্ছা, লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়া। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়া। হুমায়রা বলে, উচ্চশিক্ষা নিতে হলে তাকে কক্সবাজার সরকারি কলেজে ভর্তি হবে হবে; কিন্তু কলেজে ভর্তি এবং শহরে থাকা-খাওয়ার বিপরীতে তার মাসিক যে খরচ, তা পরিবারের পক্ষে জোগান দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

কুতুপালং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এম এ মান্নান বলেন, হুমায়রার পরিবার অত্যন্ত গরিব। আর্থিক সহযোগিতা না পেলে মেয়েটার পড়াশোনা থেমে যেতে পারে।

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন আঁখির

বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া আঁখি আক্তারের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার শ্রীকান্তদি গ্রামে। তার বাবা আলমগীর হোসেন পাটকলের শ্রমিক ছিলেন। অসুস্থতার কারণে চাকরি হারিয়েছেন। মা কাজল আক্তার গৃহিণী। তাদের আড়াই শতাংশের ভিটাটুকুই সম্বল। পরিবারের অভাব-অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী।

তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট আঁখি। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই ইমন মিয়া এইচএসসি পাসের পর লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছেন। এক মাস আগে তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি চাকরিতে যোগদান করেছেন।

আঁখি ও তার বাবার ইচ্ছা, আঁখি লেখাপড়া করে একজন চিকিৎসক হবে। আঁখি বলে, চিকিৎসক হতে অনেক দিন পড়তে হবে, কিন্তু তার বাবা বর্তমানে বেকার। বড় ভাইয়ের অস্থায়ী চাকরির সামান্য বেতনে তার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেয়েটা অনেক মেধাবী। প্রাইভেট না পড়েও এত ভালো ফল করেছে। এখন তাকে কেউ সহযোগিতা করলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

 [প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার, প্রতিনিধি, নালিতাবাড়ী, শেরপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা সংবাদদাতা, নবাবগঞ্জ, ঢাকা]