‘পাখপাখালি দেশের রত্ন, আসুন সবাই করি যত্ন’

বেলুন উড়িয়ে পাখি মেলার উদ্বোধন করা হয়। শুক্রবার সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তন প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো

পৌষের আকাশে দুই দিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। ঘন কুয়াশার চাদরে ছেয়ে গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস। হাড় কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকে দল বেঁধে শিশু, কিশোর-কিশোরী, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আগমন ক্যাম্পাসে। হাতে নানা ধরনের ফেস্টুন, মুখে মুখোশ ও গালে পাখির প্রতিচ্ছবি এঁকে এসেছেন কেউ কেউ। শাড়ি, পাঞ্জাবি পরে এসেছেন তরুণ-তরুণীরা।

আজ শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ২৪তম পাখি মেলার দৃশ্য এটি। এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ‘পাখপাখালি দেশের রত্ন, আসুন সবাই করি যত্ন’। পাখি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ পাখি মেলার আয়োজন করে থাকে। মেলায় পাখি দেখা প্রতিযোগিতা, পাখিবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পাখি চেনা প্রতিযোগিতাসহ আছে নানা ধরনের আয়োজন।

সাত বছরের শিশু তাহমিমা আফরোজকে নিয়ে ঢাকার মিরপুর থেকে মেলায় এসেছেন স্কুলশিক্ষক শাপলা আক্তার। তিনি বললেন, ‘শহরের ইটপাথরের প্রকৃতিতে পাখির দেখা মেলে না। তাই মেয়েকে নিয়ে পাখি মেলায় এসেছি। পাপেট শো এবং পাখির ছবি দেখে মেয়ে খুব আনন্দিত। আমারও ভালো লাগছে ক্যাম্পাসে শীতের আমেজ অনুভব করতে পারছি।’

পাখি বিষয়ে সচেতনতায় মেলা প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ধরনের স্টল দিয়েছেন শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণির মানুষ। তাঁদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মালিহা ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবছর পরিযায়ী পাখি আসে। কিন্তু এসব পাখি বিভিন্ন কারণে আমাদের জন্য বিরক্ত হয়। আমাদের উদ্দেশ্য হলো সচেতনতা তৈরি করা। পাখিরা যাতে বিরক্ত অনুভব না করে, তাদের বসবাসের জন্য যে নিরাপদ বাসস্থান দরকার, সেটা যেন তারা পায়।’

শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জহির রায়হান মিলনায়তন প্রাঙ্গণে বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। এ সময় তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি মেলা ও প্রজাপতি মেলা এমন মেলা, যেটা প্রকৃতির যে বৈশিষ্ট, ইউনিটি অ্যান্ড ডাইভার্সিটি, সেটা চিত্রিত হয়। ধর্ম-বর্ণ, বৃদ্ধ-শিশু সবাই এখানে একত্র হয়।

পাখি মেলার একটি দৃশ্য। শুক্রবার সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তন প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

কমেছে পরিযায়ী পাখির আগমন

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম পরিযায়ী বা অতিথি পাখি আসে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০৬ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলোতে দেখা গেছে। এগুলোর ১২৬টি দেশি প্রজাতির। বাকিগুলো বিদেশি প্রজাতির। যেসব পরিযায়ী পাখি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, বেশির ভাগই হাঁস-জাতীয়। এর মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাই ফেচার গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, পান্তামুখী, পাতারি, কোম্বডাক, পাতারি হাঁস ও কাম পাখি অন্যতম। এ ছাড়া কলাই, মানিকজোড়, কলাই, ছোটনগ, জলপিপি প্রভৃতি পাখিরও দেখা মেলে।

গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণ, সময়মতো জলাশয় পরিষ্কার না করা, প্রচুর পরিমাণে জনসমাগম, জলাশয়ের পাড়ে মানুষের বিশৃঙ্খলা, পানিদূষণসহ নানা কারণে পাখি আসার হার কমে গেছে। বছর পাঁচেক আগেও ক্যাম্পাসের পরিবহন চত্বর–সংলগ্ন জলাশয়, আল বেরুনি হল–সংলগ্ন জলাশয়, পুরোনো প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন জলাশয়, জিমনেসিয়াম–সংলগ্ন জলাশয়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হল–সংলগ্ন জলাশয়সহ বিভিন্ন জলাশয়ে শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটত। তবে বর্তমানে ক্যাম্পাসে সংরক্ষিত জলাশয় ওয়াল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার বাদে বাকি কোনো জলাশয়ে পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে না।

পাখি মেলায় দর্শনার্থীরা। শুক্রবার সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তন প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ক্রমে পরিযায়ী পাখির আগমন কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মেলার আয়োজক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ করছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা প্রতিবছর ৪ থেকে ৫ প্রজাতির হাঁস দেখতে পাই। তবে এ বছর লেকগুলোতে আমরা এই পর্যন্ত মাত্র দুটি প্রজাতি দেখতে পেয়েছি। আমরা যদি পাখির আবাসস্থল নিশ্চিত করতে পারি, পাখি যদি নিরাপদ বোধ করে, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাহলে আমরা আশা করি আবারও লেকগুলোতে পাখিরা ফিরে আসবে।’