ঘন ঘন ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল, শিডিউল বিপর্যয় ও ভোগান্তি বাড়ছে

ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর ময়মনসিংহ নগরের কেওয়াটখালী এলাকায় লোকোশেডে নিয়ে মেরামত করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহ অঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়া যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ মঙ্গলবারও দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়। পরে বিকল্প ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনায় শিডিউল বিপর্যয় ও যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। ইঞ্জিন–সংকটে ইতিমধ্যে তিনটি ট্রেন বন্ধ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের কারণে চলাচলের সময় ত্রুটি দেখা দিচ্ছে।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশনের সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, একেক দিন একেক জায়গায় একেক ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে। এ জন্য ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। হয়রানির শিকার হওয়ায় যাত্রীদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে ময়মনসিংহ-ঢাকা-জামালপুর, ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব, ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-মোহনগঞ্জ এবং জামালপুর-চট্টগ্রামগামী ট্রেন চলাচল করে। ময়মনসিংহ জংশন হয়ে মোট ২৮ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। ট্রেনের ইঞ্জিন সংকটের কারণে ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী দুটি লোকাল ট্রেন ও ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরগামী ধলেশ্বরী নামের একটি ট্রেনের চলাচল ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ময়মনসিংহ লোকোশেডে গেলে কয়েকজন কর্মী জানান, ময়মনসিংহ অঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনে ব্যবহার হওয়া ২ হাজার থেকে ৩ হাজার সিরিজের ইঞ্জিনগুলো বহু আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২০০ সিরিজ, ২ হাজার ৫০০ সিরিজ ও ২ হাজার ৮০০ সিরিজের ইঞ্জিন রেলপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি ইঞ্জিনগুলো দিয়ে চলছে ট্রেনগুলো। বিকল হওয়া ট্রেনের ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইঞ্জিনগুলোতে ইঞ্জিনের চাকা ঘোরানোর জন্য যে ট্র্যাকশন মোটর আছে, সেটির ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণেও বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে।

রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত ৩৮ দিনে একটি লাইনচ্যুত ও ১২টি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়েছে। এর মধ্যে আজ সকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের ত্রিশালের আউলিয়ানগর এলাকায় মোহনগঞ্জগামী বলাকা কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়। পরে উদ্ধারকারী ট্রেন আসার দুই ঘণ্টা পর ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এ সময় ঘণ্টাখানেক ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। আজ সকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিনও সকাল আটটার দিকে বিকল হয়। পরে বিলম্বিত সময়ে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মোহনগঞ্জগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন ময়মনসিংহ নগরের শম্ভুগঞ্জ এলাকায় ইঞ্জিন বিকল হয়। গত রোববার রাতে জামালপুরের তারাকন্দি থেকে ঢাকাগামী আন্তনগর অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেন ময়মনসিংহ জংশন এলাকায় ইঞ্জিন বিকল হয়ে দুই ঘণ্টা বিলম্বে যাত্রা করে। গত ২৯ ডিসেম্বর বেলা সোয়া একটার দিকে ত্রিশালের ধলা স্টেশনের আউটার এলাকায় মোহনগঞ্জগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় দুই ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা ছেড়ে আসা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে পিয়ারপুর এলাকায় আটকা পড়ে। একই দিন ইঞ্জিন সমস্যার কারণে ময়মনসিংহ থেকে জারিয়াগামী লোকাল ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়।

গত ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল ও একটি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকাগামী জামালপুর কমিউটার ময়মনসিংহ জংশন এলাকায় লাইনচ্যুত, চট্টগ্রাম ছেড়ে আসা ভুয়াপুরগামী নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ময়মনসিংহ জংশনে ইঞ্জিন বিকল হয়। একই দিন ত্রিশালের আউলিয়ানগর এলাকায় ঢাকা থেকে দেওয়ানগঞ্জগামী দেওয়ানগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় এবং জামালপুর ছেড়ে আসা ঢাকাগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ময়মনসিংহ জংশনে ইঞ্জিন বিকল হয়। গত ২ ডিসেম্বর সকালে গফরগাঁও উপজেলার মশাখালী রেলওয়ে স্টেশনে জামালপুর কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়। পরে বিকল্প ইঞ্জিনে ৫ ঘণ্টা পর ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

ময়মনসিংহ রেলের লোকোশেডের ইনচার্জ মোহাম্মদ ফারুক হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত মালামালের ঘাটতি আছে। স্থানীয়ভাবে মেরামত করার পর আবার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ইঞ্জিনগুলোর কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় মেরামতের পর টেকসই হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, লোকোশেড ও জংশন স্টেশনে দুটি বিকল্প ইঞ্জিন সার্বক্ষণিক থাকার কথা থাকলেও বিপর্যয়ের কারণে স্টকে কোনো ইঞ্জিন থাকছে না। ৮১ জন জনবলের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ২৯ জন। পরিস্থিতি সামাল দিতেও সমস্যা হচ্ছে।

এদিকে ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন। গফরগাঁও থেকে ময়মনসিংহ শহরে নিয়মিত যাতায়াত করা তোফায়েল আহমেদ বলেন, একটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হলে অন্য ট্রেনগুলোও আটকে থাকে। একটি ট্রেনের পাশাপাশি অন্য ট্রেনের যাত্রীদেরও ভোগান্তি হয়। ভোগান্তিবিহীন রেলসেবার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

নাগরিক সংগঠন ময়মনসিংহ ফোরামের কো-অর্ডিনেটর সাঈদ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুরাতন ইঞ্জিনগুলো বিকল হওয়ার আগে কী কারণে রুটিন চেকআপের মাধ্যমে ইঞ্জিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছে না, সেটা খেয়াল করা দরকার। একদিকে বাসের ভাড়া বাড়ানো অন্যদিকে ট্রেনগুলোকে বিকল করে ফেলা যথেষ্ট সন্দেহজনক। স্বস্তিদায়ক যাত্রার জন্য ট্রেনগুলোকে উপযোগী করে তোলার দাবি জানান তিনি।