থমকে গেছে খুলনার তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির গতি
একের পর এক সাফল্য দেখিয়ে আলোচিত খুলনার বটিয়াঘাটার মেয়েদের ফুটবল একাডেমি তেঁতুলতলা সুপার কুইনের গতি একেবারে থমকে গেছে। কোচ নেই, ঈদুল ফিতরের পর থেকে অনুশীলন পুরোপুরি বন্ধ। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এসব খেলোয়াড়ের বেশির ভাগই এখন খেলার মধ্যে নেই। দুজনের বিয়ে হয়েছে। অন্যরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
খেলোয়াড়, গ্রামের লোকজন ও দল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুপার কুইনের কোচ এলাকার একসময়ের খেলোয়াড় মো. মোস্তাকুজ্জামানকে প্রথমে একাডেমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে খালিদ সাইফুল্লাহ ও দস্তগীর হোসেন নামের আরও দুজন কোচকে ধরে রাখতে পারেনি একাডেমি। এরপর থেকে এই একাডেমি শুধু পিছু হটছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও আর্থিক সংকটে একাডেমির কার্যক্রম গতি হারিয়েছে।
‘মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে’—এমন কথা তুলে গত বছরের ২৯ জুলাই একাডেমির নারী খেলোয়াড়দের ওপর হামলা করেছিল স্থানীয় একদল দুর্বৃত্ত। ওই ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি ওঠে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়। নানা জায়গা থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে মেয়েরা আবারও মাঠে ফেরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিশ্রুতিগুলো ভুলতে থাকেন সবাই। একসময় তাঁদের নিয়ে কেউ কিছু ভাবা যেন বন্ধই করে দেন!
মারধরে মাথা ফেটে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সুপার কুইনের খেলোয়াড় মঙ্গলী বাগচী। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি খুলনা জেলা ও বিভাগীয় দলে খেলেছেন। তিনি বলেন, ‘গত নভেম্বরে ক্লাব ছেড়ে বাড়ি চলে এসেছি। আসলে আমাদের বাড়ি আসতে বাধ্য করা হয়েছে। আমাদের কোচকে ওখান থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে আমরা আর খেলতে না পারি। হামলার শিকার জুঁইকে বিয়ে দিয়েছে পরিবার। আমার মতো সবাই বসে আছে। খেলার ইচ্ছা আছে; কিন্তু অনুশীলনের সুযোগ নেই। আঘাত পেয়ে আহত হওয়ায় টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারিনি। এইচএসসি পরীক্ষাটাও দেওয়া হলো না। সব মিলিয়ে খুব মনঃকষ্টে আছি।’
একাডেমির রক্ষণভাগের খেলোয়াড় স্বর্ণা রায়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। স্বর্ণা বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকের খেলতে দিতে আপত্তি নেই। তবে খেলার সুযোগ তো নেই—ক্লাবে অনুশীলন, খেলা সবই তো বন্ধ।’
২০১৩ সাল থেকে তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপে বারবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও খুব ভালো করছিল। মেয়েদের ফুটবল নিয়ে ভালো কিছু করার তাগিদে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে তেঁতুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ফুটবল একাডেমি সুপার কুইনের কার্যক্রম শুরু হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক দেবাশীষ মণ্ডল স্থানীয় কয়েকজন ক্রীড়া সংগঠককে এই ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন স্কুল-কলেজে পড়া ৩০-৪০ জন মেয়ে একাডেমিতে নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন করতেন। আর্থিক সংকটে এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে বটিয়াঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম প্রধান উপদেষ্টা হয়ে এর কার্যক্রম এগিয়ে নেন।
জলমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পরিবেশ ও বন বিষয়ক সম্পাদক ইসলাম হাওলাদারকে একাডেমির সভাপতি, একাডেমি দলের অধিনায়ক ঋতু বৈরাগীর বাবা দিলীপ বৈরাগীকে সহসভাপতি করে স্থানীয় নারী-পুরুষদের নিয়ে কমিটি করা হয়। নারী ফুটবলারদের ওপর হামলার পর সহসভাপতির বাড়িতে মেয়েরা থাকতে শুরু করে। ওই বাড়িতে কিছুদিন পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়।
একাডেমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্তত পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হামলার ঘটনার কিছুদিন পর থেকে সভাপতি ও সহসভাপতি মিলে একাডেমির ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেন। সহসভাপতি দিলীপ বৈরাগীকে দলের ব্যবস্থাপক ঘোষণা করা হয়। এরপর তাঁরা নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন। তাঁদের মতো করে না চলায় একসময় দলের কোচকে তাঁরা সরিয়ে দেন। বাড়িতে থাকা মেয়েদের নানা অজুহাতে বের করে দেন। জেলার বাইরে একাডেমির খেলোয়াড়দের খেলতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ফুটবলার সাদিয়া নাসরিনসহ অন্য তিনজনকে তাঁরা একাডেমি থেকে বের করে দেন। অন্যরা অনুশীলন থেকে বিরত থাকেন।
নারী ফুটবলারদের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলার বাদী ছিলেন সাদিয়া নাসরিন। তিনি অভিযোগ করেন, মামলার দেখভাল ও সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সভাপতি ও সহসভাপতি তাঁদের কাছে টাকা দাবি করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আসামিরা বর্তমানে জামিনে আছেন। ২৫ জুন মামলার শুনানি আছে। আমাদের একাডেমির লোকজন বলেছেন, আমি যেহেতু ক্লাবে নেই, তাঁরা আমার হয়ে সাক্ষ্য দেবেন না। ক্লাবের সভাপতিসহ অনেকে আসামিদের সঙ্গে সখ্য রেখে চলেন। মামলা তুলে নেওয়ার কথা বলছেন। মামলা নিয়ে বড় ঝামেলায় আছি। একসময় সবাই সঙ্গে ছিল, আস্তে আস্তে পিছুটান দিচ্ছে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে একাডেমির সভাপতি ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘তাদের বের করে দেওয়ায় একাডেমির ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। খেলতে যাওয়ার একটি বিষয়ে কথা না রাখায় আশরাফুল আলম ভাই (একাডেমির প্রধান উপদেষ্টা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) নিজেই সাদিয়াকে বের করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ভাইকে বুঝিয়েছি। সাদিয়াকেও ডেকেছি। এক করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। অন্য অভিযোগগুলো সত্য না।’ একাডেমির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আর্থিক সংকট বড় সমস্যা। আশরাফুল আলম এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেননি। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। তবে একাডেমি ধরে রাখার চেষ্টা করব।’
প্রসঙ্গত, আশরাফুল আলম এই ফুটবল একাডেমির অর্থের মূল জোগানদাতা ছিলেন। তিনি এখন আর আর্থিক সহায়তা করছেন না, এমনটাই বলছেন কমিটির অন্যরা।
তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির একজন প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা দেবাশীষ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আর্থিক সংকটের কারণে আমরা একাডেমি চালাতে পারছি না। মাসে একজন কোচকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া লাগে। সহায়তা ছাড়া ওই টাকা দেওয়ার সক্ষমতা একাডেমির তৈরি হয়নি।’
এমন নানা সংকটে ১০ বছরের টানা চ্যাম্পিয়ন দলটি দুই বছর ধরে প্রতিযোগিতার প্রথম ধাপ থেকেই বাদ পড়েছে। দারিদ্র্য জয় করে ফুটবল নিয়ে মেয়েদের দেখা রঙিন স্বপ্নগুলো ফিকে হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে।