‘এখানেই জীবনের সব সুখ খুঁজে পাই’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মৃৎশিল্প বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন কুয়াশা বিন্দু (৩৮)। এরপর শিল্পের টানে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। এখন প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকেন তিনি। তৈরি করেন ভাস্কর্য ও ম্যুরাল।
কুয়াশা বিন্দুর বাড়ি গাজীপুরের বাড়িয়া ইউনিয়নের বাড়িয়া গ্রামে। বর্তমানে থাকছেন নগরের বোরা এলাকায়। এখানে প্রায় সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর রয়েছে তাঁর শিল্পচর্চার স্টুডিও। বেশির ভাগ সময় সেখানে কাটান তিনি।
কখনো কখনো ছবি আঁকার জন্য নিবিড় কোনো গ্রামে চলে যান কুয়াশা বিন্দু। সেখানে রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন গ্রামবাংলার নানা ঐতিহ্য। এ ছাড়া ভাস্কর্য ও কাঠের ওপর ম্যুরালের কাজ করেন। এরই মধ্যে তাঁর বেশ কয়েকটি শিল্পকর্ম জায়গা করে নিয়েছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও কার্যালয়ে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে সদর হাসপাতাল সড়ক ধরে তিন কিলোমিটার গেলে হাতের বাঁয়ে বোরা গ্রামে কুয়াশা বিন্দুর স্টুডিও। টিনের ছাউনি দেওয়া আধা পাকা ঘরের চারপাশে সবুজ গাছগাছালি।
গত সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় কুয়াশা বিন্দুর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ করছেন। এ সময় কুশল বিনিময় শেষে নিজের একটি ভাস্কর্যের কাজ প্রসঙ্গে কুয়াশা বলেন, ‘এটা বাড়িয়ার গণহত্যার ওপর করছি। এখনো অনেক কাজ বাকি। হাতেও সময় কম। তাই একটু ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’
বাড়িয়া গাজীপুরের বাড়িয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম। ১৯৭১ সালের ১৪ মে এখানে সংঘটিত গণহত্যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০ ব্যক্তি শহীদ হয়েছিলেন। এই গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার—যে কাজটি করছেন কুয়াশা বিন্দু।
স্টুডিওর ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ছোট ছোট টেবিলের ওপর এলোমেলোভাবে রাখা নানা শিল্পকর্ম, যেগুলো কাঠ, মাটি, বাঁশসহ নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। নেতৃত্ব, পরিবার, জাগো, নিরাপত্তা, ধ্যান, পিতার সংসারসহ বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে এসব শিল্পকর্মের। পাশেই একটি ছোট্ট ঘরে এলোমেলো রাখা তাঁর আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম।
কুয়াশার ভাষায়, ‘যখন যেটা মাথায় আসে, সেটাই করি। এত কাজ জমে যায় যে রাখার জায়গা থাকে না। ছাত্রজীবন থেকে এ পর্যন্ত আমার অসংখ্য কাজ এভাবে নষ্ট হয়েছে। অনেকে বিনা মূল্যে নিয়ে গেছেন।’
আলাপের একপর্যায়ে পড়াশোনা শেষে গ্রামে ফিরে আসা এবং অন্যকিছু না করে কেবল শিল্পচর্চা চালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ জানতে চাই। এ সময় কুয়াশা বলেন, তাঁর বাবা অতিন্দ্র চন্দ্র দাস সরকারি চাকরি করতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর আঁকাআঁকির নেশা। স্কুল-কলেজে পড়া অবস্থায় যেকোনো বিষয়ের ওপর ছবি এঁকে ফেলতে পারতেন তিনি। এভাবে শিল্পের প্রতি টান থেকে কলেজ পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মৃৎশিল্প বিভাগে।
২০১৩ সালে স্নাতক পাস করেন কুয়াশা। এর পর থেকে পরিবার থেকে শুরু হয় চাকরির তাগাদা। একপর্যায়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে চাকরি নেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু কিছুতেই সেখানে তাঁর মন বসছিল না। পরে শিল্পের প্রতি দুর্নিবার টানে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন নিজ গ্রামে।
কুয়াশা বিন্দু বলেন, ‘আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনো শিল্পচর্চাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এখনো একজন শিল্পীকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। তাই পড়াশোনা শেষ হতেই পরিবার আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। বারবার তাগাদা দেয় চাকরির জন্য। কিন্তু নিজের আঁকাআঁকির প্রতি টান থেকে এটাকেই জীবনের অংশ করে নিতে চেয়েছি। তাই সব ছেড়েছুড়ে চলে আসি গ্রামে।’
কুয়াশা বিন্দু বিবাহিত। স্ত্রী বীথি দাস চাকরি করেন একটি সরকারি দপ্তরে। তাঁদের দুটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। বিভিন্ন সময় ম্যুরাল, ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভের ফরমাশি কাজ করে থাকেন কুয়াশা। এতে যা পারিশ্রমিক পান সেটা এবং স্ত্রী বীথি দাসের আয়ে সংসার চলে।
কুয়াশার ভাষ্য, ‘চাকরিতে আমি টাকা পাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু মনের যে আনন্দ, কাজের যে নেশা—সেসব পাচ্ছিলাম না। বারবারই মনে হচ্ছিল, আমার নিজের শিল্পচর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এর বিকাশ হচ্ছে না। সে জন্য চাকরি নিয়ে অনেক দিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি। পরে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েই গ্রামে ফিরে আসি। এই যে গ্রামের শান্ত পথেঘাটে বসে ছবি আঁকি, মাটি ও মানুষের কাছে যাই, এটা আমার ভালো লাগে। এখানেই জীবনের সব সুখ খুঁজে পাই।’