দুর্নীতি আর পরিকল্পনাহীনতায় ডুবেছে খুলনার শিল্পকারখানা

দেশ স্বাধীনের আগে থেকে খুলনায় একের পর এক গড়ে ওঠে শিল্পকারখানা। আশির দশকেও এসব কারখানা ঘিরে ছিল হাজারো মানুষের ব্যস্ততা। একে একে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থান হারিয়েছেন মানুষ। ভাটা পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। শিল্পাঞ্চলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

কাগজ তৈরির কারখানার ভেতরে সুনসান। কারখানা প্রাঙ্গণ জঙ্গলে পূর্ণ। পড়ে আছে কারখানার পরিত্যক্ত কাঠামো। গতকাল খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলেছবি: সাদ্দাম হোসেন

পাটকল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের শিল্পের জন্য একসময় নামডাক ছিল খুলনার। কিন্তু এখন সবই অতীত। একদিকে নতুন কারখানা গড়ে ওঠেনি, অন্যদিকে একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে বড় বড় পাটকল। দীর্ঘদিন লোকসানের পর এসব কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক।

কারখানার ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতায় একদিকে সঠিক কৌশল নিতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ, অন্যদিকে পরিচালন ব্যয় বেড়ে লোকসান বেড়েছে। নানা সময়ে লোকসানের নানা কারণ চিহ্নিত হয়েছে। করা হয়েছে বিভিন্ন পরিকল্পনা। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কারখানা বন্ধের পেছনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকেও দায়ী করেন কেউ কেউ।

খুলনার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দায়ী। তাদের পরামর্শে ১৯৮০-৮৫ সালে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচির নামে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নামমাত্র মূল্যে বেসরকারি খাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাট খাতে একাধিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে বাধ্যতামূলক অবসর, কারখানা বন্ধের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। বারবার লোকসানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বা অন্যান্য সেবা খাতের সুবিধার কথা কখনো বিবেচনা করা হয়নি। সরকারের দিক থেকে লোকসান কমানোর কোনো চেষ্টাই ছিল না।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে একে একে সব কারখানা শেষ হয়েছে। এ জন্য শ্রমিকদের একটা অংশ দায়ী। কারখানার ব্যবস্থাপক ও অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশে শ্রমিকনেতারা দুর্নীতি করেছেন।
কুদরত-ই-খুদা, আহ্বায়ক, পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ

বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাটকলে লোকসানের বড় কারণ কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট। পাটকলগুলো দেরিতে বেশি দামে পাট কিনত। সরকারি পাটকলে কম উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন খরচ বেশি, পুরোনো যন্ত্রপাতি ও বেসরকারি খাতের তুলনায় শ্রমিকের মজুরি ছিল বেশি। অবিক্রীত পণ্য গুদামে পড়ে থাকত। প্রতিবছর পাটের মৌসুমে কাঁচা পাট কিনতে সরকারের কাছে হাত পাততে হতো। এ ছাড়া বাজারজাতকরণে উদ্যোগ, সমন্বয়হীনতা, কাঁচামালের সংকট, বেশি জনবল, সিবিএর দৌরাত্ম্য—পাটকলগুলোর লোকসানের অন্যতম কারণ।

নাম প্রকাশ না করে বিজেএমসির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অর্থের অভাবে সময়মতো পাট কেনা যেত না। জুলাই মাস পাট কেনার ভরা মৌসুম হলেও সময়মতো অর্থ না পাওয়ায় কেনা হতো অক্টোবর-নভেম্বরে। এ ছাড়া লোকসানের আরেকটি কারণ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। আওয়ামী লীগের সময় হাজার হাজার শ্রমিককে স্থায়ী করা হয়েছে। লোকসানে জর্জরিত সরকারি পাটকলে প্রায় তিন গুণ মজুরি বাড়ানো হয়েছে। এতে খরচও অনেক বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন

পাটকলের দুর্দশার জন্য সব সময় সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের দায়ী করার প্রবণতা ছিল। তবে শ্রমিকনেতারা শ্রমিকদের দায় দেখেন না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক সোহরাব হোসেন বলেন, শ্রমিক উৎপাদন দেন, কাজ করেন। তাঁরা মালামাল কেনেনও না, বিক্রিও করেন না। পাট কেনায় ছিল সবচেয়ে বড় অনিয়ম। মৌসুমে কম দামে পাট না কিনে এক হাজার টাকা মণের পাট দেড়-দুই হাজার টাকায় কেনা হতো। এটা ছিল সিন্ডিকেট। কাঁচা পাটের ব্যবসায়ীরা বিজেএমসিকে ম্যানেজ করতেন। ব্যবসায়ীরাই কম দামে পাট কিনে গুদামজাত করতেন। তাঁদের থেকে পাট কিনত কারখানাগুলো। লোকসানের জন্য ৬০-৭০ শতাংশ দায়ী এই সিন্ডিকেট।

বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন। সবই এখন স্মৃতি। খালিশপুর, খুলনা, জানুয়ারি ২০১৮
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বললে ব্যবস্থার বদলে শাস্তি জুটত মন্তব্য করে সোহরাব হোসেন বলেন, দেখাশোনার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই এসব চুরি করতেন। সিন্ডিকেটে মন্ত্রী, সচিবালয় পর্যন্ত হাত ছিল। যখনই তাঁরা এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন, তাঁদের অনেককে বরখাস্ত করা হয়েছে। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ কেনারও অভিযোগ করেন তিনি।
লোকসানের পেছনে সিবিএ নেতাদেরও দায় দেখেন পাট খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শ্রমিকের সংখ্যা অনুযায়ী সিবিএর কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। আদমজীর পরে দেশের সবচেয়ে বড় পাটকল ক্রিসেন্ট জুট মিলে পরিষদ হতো ২৫ জনের। নিয়ম হচ্ছে, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি কর্মস্থলে থাকবেন, অন্যদের কাজ করতে হবে। তবে কার্যনির্বাহী পরিষদের কেউ উৎপাদনে শ্রম দিতেন না। সব মিলিয়ে পাটকলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে নেতাদের অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

সম্প্রতি শ্রমিকদের এক আড্ডায় গিয়ে পাটকলে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা শোনা হয়। তাঁরা জানান, অতিরিক্ত শ্রমিক দেখানোর ঘটনা নিয়মিত ছিল। মূলত তিন পালায় কাজ হতো। রাতের পালার নাম ছিল ‘সি শিফট’। সেখানেই চলত কারসাজি। হয়তো ১০০ জন কাজ করছেন। দেখানো হতো ৩০০। শ্রমিকের সংখ্যার তুলনায় উৎপাদিত পণ্যের যে ঘাটতি হতো, আগের উৎপাদিত পণ্য মেপে উৎপাদনের ঘাটতি কিছুটা মেটানো হতো। এটা করতে গিয়ে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটেছে, ২০ টন কাঁচা পাটে অনেক সময় ২২ টন চূড়ান্ত পণ্য উৎপাদন হয়ে গেছে। পরে সেসব ঠিক করা হয়। দু-একটা শাস্তির ঘটনাও আছে।

জাতীয় পাট ও পাটশিল্প রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. খালিদ হোসেন বলেন, উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত পরতে পরতে দুর্নীতি। বিজেএমসির কর্মকর্তা থেকে অসাধু শ্রমিকনেতা—সবাই জড়িত। এক-এগারোর সময় দুর্নীতির কারণে অনেক শ্রমিকনেতা পালান। শ্রমিক নিয়োগেও বাণিজ্য হয়েছে। কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে ৫০০ শ্রমিকের হাজিরা দেখিয়ে অনেক সময় কাজ করিয়েছে ২০০ জনকে। মজুরির বড় অংশ গেছে তাঁদের পকেটে। সিবিএর নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য হতে তাঁরা লাখ টাকা খরচ করতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় সরকারি পাটকলে বাম রাজনীতির অনুসারী ইউনিয়নগুলো প্রভাবশালী ছিল। নব্বইয়ের পর প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লোকজন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। এর আগে সামরিক শাসনামলে শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দুর্বল করতে প্রশাসন সিবিএতে নিজেদের লোক তৈরির চেষ্টা করেছে।

দেখে মনে হবে পরিত্যক্ত ভূতুড়ে স্থান, অথচ কয়েক বছর আগেও এখানে পাটকল শ্রমিকেরা থাকতেন। প্লাটিনাম জুট মিলস, খুলনা, ২৮ ডিসেম্বর
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খালিদ হোসেন বলছিলেন, ‘সামরিক শাসকেরা ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন ধ্বংসের চেষ্টা করেছিলেন। পরিকল্পনা করে অর্থ, অস্ত্র, ভয়, পদের লোভ দেখানো হতো। আমাকে সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে লোভ দেখানো হয়েছিল।’ তিনি বলেন, অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাহীনতা, দূরদর্শিতার  অভাব ও পরতে পরতে দুর্নীতি পাটশিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিশ্ব এখন পাটপণ্যের দিকে ছুটছে। এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। শিল্প বাঁচাতে তাঁরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সরকারই বাস্তবায়ন করেনি।

পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক কুদরত-ই-খুদা বলেন, পাট খাত ঘিরে কখনোই বড় সংস্কার পরিকল্পনা হয়নি। কারখানা কর্তৃপক্ষ ঠিক থাকলে শ্রমিকনেতাদের দুর্নীতির সুযোগ নেই। এখনো বসে বসে টাকা নিচ্ছেন বিজেএমসির কর্মকর্তারা। শ্রমিকদের অনেকের মজুরি বকেয়া অথচ ব্যবস্থাপকের বাসায় গরু দেখতে রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত লোক কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে একে একে সব কারখানা শেষ হয়েছে। এ জন্য শ্রমিকদের একটা অংশ দায়ী। কারখানার ব্যবস্থাপক ও অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশে শ্রমিকনেতারা দুর্নীতি করেছেন।