নির্বাচনী সংস্কৃতিতে প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা নতুন নয়। পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে একাধিক ব্যালটে প্রকাশ্যে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার নজির অনেক আছে। গোপন কক্ষে সিল মেরে আনা তো সময় সাপেক্ষ। তাই এ ক্ষেত্রে তাঁদের আস্থা রবিবাবুর ‘এত সময় কোথায়, সময় নষ্ট করবার’ বাণীতে। দেশের ইতিহাসে প্রথম গণভোট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এমন অভিযোগ ছিল। অতীতে এসব ঘটনায় হয়তো ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়েছে, নয়তো অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আবার কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই পার পেয়েছে অনেকে।
প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারায় জড়িত ব্যক্তিদের কাঠগড়ায় যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে। এ যেমন গত বছর লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩টি ব্যালটে প্রকাশ্যে সিল মেরে নিজের ক্ষমতা জাহির করেছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আজাদ হোসেন। পরে তাঁকে শ্রীঘর ঘুরে আসতে হয়েছে।
তবে এমন কাণ্ড যখন কোনো আইনপ্রণেতা কিংবা জনপ্রতিনিধি করে থাকেন, তখন বিষয়টা ভাবিয়ে তোলে। নিজের ভোটটি দিতে গিয়ে তাঁদের প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারার কারণ ভিন্ন। কেউ কেউ নিজের ক্ষমতা জাহির করতে, কেউবা নিজেকে প্রমাণ করতে, আবার কেউবা ব্যালটের গোপনীয়তা সম্পর্কিত আইনটিকে অবজ্ঞা করে ইচ্ছাকৃতভাবে এই কাজ করে থাকেন। এই তালিকায় বর্তমান ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান যেমন রয়েছেন তেমনি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত-সমালোচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানও আছেন। তালিকার সবশেষ সংযোজন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কাশিয়াইশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম।
৫ জুন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের স্থগিত কেন্দ্র পূর্ব পিঙ্গলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে গিয়ে আবুল কাসেম প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারেন। অবশ্য সিলটি মেরেছেন তাঁর পক্ষে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আশীষ দে। ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কেন্দ্রটিতে। ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি গোপন কক্ষে যেতে রাজি হননি। দুটি ব্যালট পেয়েই তাঁর উপস্থিতিতে আশীষ চেয়ারম্যানের পছন্দের দুটি প্রতীকে সিল মারেন জনসমক্ষে। যদিও ওই দুই প্রতীকের প্রার্থীই পরাজিত হয়েছেন।
প্রকাশ্যে ভোট দেওয়ার ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ব্যালট বাক্সে ফেলার পর চেয়ারম্যান সাহেব পকেটে হাত দিয়ে টাকার বান্ডিলও বের করেছিলেন। হয়তো তাঁর সঙ্গে থাকা অনুসারী কিংবা কর্তব্য পালনকারীদের ‘বকশিশ’ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। তিনি নাকি প্রায়ই এটা করে থাকেন। কিন্তু কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হওয়ায় শেষ কার্যটি ভোটকক্ষে করতে পারেননি।
আবুল কাসেম খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তাই তাঁকে ব্যক্তিগত সহকারী বা কারও সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। সেদিনও তিনি স্কুল ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে ভোটকক্ষে যান। কিন্তু গোপন কক্ষে তাঁকে পাঠাতে পারেননি ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তারা। তাঁদের আর ক্ষমতাও কতটুকু! এই আবুল কাসেমের ভয়ে তটস্থ যেখানে পুরো কাশিয়াইশ ইউনিয়নের জনপদ।
এক সপ্তাহ আগে ২৯ মে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের দিন তাঁর নেতৃত্বেই দখল হয়েছিল পূর্ব পিঙ্গলা ভোটকেন্দ্রটি। দখল বললে ভুল হবে। তিনি নিজে ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে ৫৫১টি ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে এ ঘটনায় পরবর্তী সময়ে করা মামলায় ‘ভাশুরের’ নামটি উল্লেখ করতে বোধ হয় ভয় পেয়ে থাকতে পারেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাই অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনের বিরুদ্ধে ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগে এজাহার দেওয়া হয়।
সেই চেয়ারম্যান আবুল কাসেম পুনরায় ভোটের দিন প্রকাশ্যে ভোট দেওয়ার মতো কাণ্ড ঘটালেন। ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে অবগত হয়ে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ারম্যানকে ভর্ৎসনা করেছেন ঠিক। প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ একটা নির্বাচনের কালিমা বলতে এ একটি ঘটনা। কিন্তু এমন ঘটনায় অদ্যাবধি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কমিশন থেকে। এ-সংক্রান্ত আইনে কী রয়েছে, একবার দেখে আসা যাক।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ৩১-এর উপধারায় বলা হয়েছে, ব্যালট পেপার প্রাপ্তির পর ভোটার তাৎক্ষণিকভাবে ব্যালট পেপার চিহ্নিত বা সিল মারার জন্য নির্ধারিত স্থানে (গোপন কক্ষে) চলে যাবেন। প্রতিবন্ধী হলে অন্যের সহযোগিতায় ভোটদানের বিধান রয়েছে। কিন্তু তা কোনোভাবেই প্রকাশ্যে নয়।
আবার আইনে এটাও উল্লেখ রয়েছে কোনো ব্যক্তিকে বকশিশ প্রদান করেন বা প্রস্তাব করেন বা প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার কোনো ব্যালট পেপার বাইরে প্রদর্শনের জন্য কোনো ব্যক্তির তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসনের একটি কেন্দ্রে গোপন কক্ষে না গিয়ে প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। নির্বাচনের পর তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। কিন্তু প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনায় মন্ত্রীকে ইসির শুনানিতে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।
এখন একই ধরনের অপরাধে ইউপি চেয়ারম্যান কাসেমের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হবে, তা দেখার বিষয়। নাকি এ ক্ষেত্রেও ব্যালট ছিনতাইয়ের মামলার অজ্ঞাতনামা আসামির মতো তাঁকে রক্ষা করার পথ খুঁজবে।
লেখক: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক