ক্যাম্পাসের পরিচিত রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন আফসানা করিম (রাচি)। হঠাৎ একটি দ্রুতগামী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এসে পেছন থেকে তাঁকে ধাক্কা দেয়। গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হন। তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গত মঙ্গলবার রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। মাত্র মাসখানেক আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছিলেন মার্কেটিং বিভাগের ৫৩ ব্যাচের (প্রথম বর্ষ) এই শিক্ষার্থী। প্রিয় ক্যাম্পাসেই তাঁর প্রাণ ঝরে যাওয়ায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা বলছেন, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্ঘটনাসহ প্রতিনিয়তই নানা অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় পরছেন শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা। এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ব্যাটারিচালিত দুই রিকশার সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী পূজা মজুমদার। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। নিয়মিত ওষুধ খান।
ক্যাম্পাসের একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্পাসে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনে রয়েছে মূলত অব্যবস্থাপনা আর প্রশাসনের গাফিলতি। ক্যাম্পাসে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চললেও কোনো শৃঙ্খলা নেই। মূল ফটক ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থান দিয়ে খুব সহজেই প্রবেশ করতে পারে যানবাহন, যা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে কঠোর হতে দেখা যায় না। ক্যাম্পাসে যাঁরা রিকশা চালান, তাঁদের বেশির ভাগ অদক্ষ। ক্যাম্পাসের সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। কয়েকটি স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে রিকশা চালানোর জন্য এস্টেট শাখা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। বর্তমানে ক্যাম্পাসে চলাচলের জন্য ৩১০টি ব্যাটারিচালিত রিকশাকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ রিকশার নিবন্ধন পাওয়ার পর মালিকেরা রিকশাটি দৈনিক চুক্তিতে আগ্রহী চালকের কাছে ভাড়া দেন। এর মধ্যে অধিকাংশ রিকশাচালকের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে না। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা সমস্যায় পড়ে ক্যাম্পাসে রিকশা চালানো শুরু করেন। কিছুদিন পর আবার তাঁরা চলে যান। এভাবে প্রতিনিয়তই অদক্ষ রিকশাচালক ক্যাম্পাসে রিকশা চালানোয় দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে ক্যাম্পাসে হাতে গোনা প্যাডেলচালিত রিকশা চলাচল করে। এর জন্য নিবন্ধনের প্রয়োজন হয় না।
এই নিবন্ধনপ্রক্রিয়া নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এস্টেট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ধাপে মোট ৩১০টি ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়। প্রথম ধাপে ক্যাম্পাসে যাঁরা প্যাডেলচালিত রিকশা চালাতেন, তাঁদের ১৫০ জনকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের ধাপে নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করা হলে অন্তত ১০০০ আবেদন জমা পড়ে। এগুলো থেকে লটারির মাধ্যমে কিছু রিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়। বাকিগুলো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সুপারিশে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধন পাওয়া ব্যক্তির রিকশা রয়েছে কি না এবং চালক দক্ষ কি না, তা যাচাই করা হয়নি।
এ ছাড়া ক্যাম্পাসে নিবন্ধন রিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিরাপত্তা শাখার। কিন্তু নজরদারির অভাবে প্রতিনিয়ত ক্যাম্পাসে অনিবন্ধিত রিকশাও চলাচল করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রিকশাচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসের পাশে থাকি। রিকশা চালাইতে গেলে হিসাব করি, এইখানেই থাকি এইখানেই ঘুরি। তাই সাবধানে চালাই। এখন সাভার, নয়ারহাট থিকা রিকশা ক্যাম্পাসে ঢুইকা যায়। ওদের তো কোনো ভয় নাই, ইচ্ছামতো চালাইয়া যায়গা। ক্যাম্পাসে নম্বর দেওয়া গাড়ি ৩১০টা, অথচ ঢুকে ৬০০–এর বেশি।’
অভিযোগের বিষয়ে এস্টেট শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার (সদ্য সাময়িক বহিষ্কৃত) আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ার রিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে চালকের দক্ষতা যাচাই করা হয়। সবকিছু প্রশাসনিকভাবে হয়েছে। তবে অনেকে নিবন্ধন পাওয়ার পর চালক পরিবর্তন করেন, সে বিষয়টি নিরাপত্তা শাখাকে দেখতে হবে। এ ছাড়া বাইরে থেকে ক্যাম্পাসে রিকশা এলে সেটি তো আর এস্টেট শাখা দেখতে পারবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রিকশাচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নিজের রিকশা ছিল। ছয়বার নম্বরের (অনুমোদনের) জন্য কাগজ জমা দিয়া নম্বর পাই নাই। এরপর নম্বর আছে এমন রিকশা ভাড়া নিয়া ক্যাম্পাসে চালাইছি। ক্যাম্পাসের নম্বর আছে সেসব রিকশায়, সেগুলো দৈনিক ভাড়া একটু বেশি দিতে হয়।’
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হলেও বাইরের সড়কে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। মূল ফটকে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও অকেজো দীর্ঘদিন ধরে।
একাধিক শিক্ষার্থী জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রেখে নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পর ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া গত কয়েক বছরের বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা শাখায় জনবল–সংকট, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, সীমানাপ্রাচীরের উচ্চতা বৃদ্ধি, ফটকগুলোর সংস্কার ও প্রাচীরের ফাঁকা অংশে দেয়াল নির্মাণের বিষয়টি জানানো হয়। বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সভায় প্রক্টরকে পুনরায় বিষয়গুলো জানিয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এরপরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
নিরাপত্তা শাখার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এসব বিষয় জানিয়ে প্রশাসনের কাছে নথি উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আর কোনো নির্দেশনা বা পদক্ষেপের বিষয়টি জানেন না তাঁরা।
এসব বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র দুই মাস হলো আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। ইতিমধ্যে সিমানাপ্রাচীরের বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়ে ইতিমধ্যে দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি জানিয়েছেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে শাটল বাস বা অন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে।’
মঙ্গলবারের দুর্ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের সামনে রাস্তা পার হওয়ার সময় গতকাল রাতে একটি দ্রুতগামী অটোরিকশা তাঁকে আঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে রাত পৌনে আটটার দিকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ক্যাম্পাসে চা–বিক্রেতা কিশোর মো. মাহিম প্রথম আলোকে জানিয়েছে, কলাভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে ওই শিক্ষার্থী হেঁটে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা ধাক্কা দিলে তিনি পড়ে গিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যান। পরে তাঁকে কয়েকজন চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান এবং রিকশাচালক চলে যান।
মার্কেটিং বিভাগের সহপাঠীরা জানান, ক্লাসে সামনের বেঞ্চে বসতে ভালো লাগত আফসানার। বন্ধুদের সঙ্গে এ নিয়ে প্রায়ই প্রতিযোগিতাও করতেন। স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার। নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে না থাকলেও সহপাঠীদের সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। দেখা হলেই মিষ্টি হাসি দিয়ে আলাপ শুরু করতেন। সেই আফসানা আর ফিরবে না ভাবতেই পারছেন না তাঁরা।