সুনামগঞ্জের তিন উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিনটি উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আজ সকালে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কে তোলাছবি: খলিল রহমান

সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারী বৃষ্টির সঙ্গে উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত আছে। এ কারণে নদী ও হাওরে পানির প্রবাহ আরও বেড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাহিরপুর উপজেলা।

তাহিরপুর উপজেলায় রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরে বেশি পানি উঠেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছে প্রশাসন।

জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, শহরের ষোলঘর পয়েন্টে আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ৮ দশমিক ১৩ মিটার, যা বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপরে। গতকাল সোমবার একই সময়ে সেখানে পানি ছিল বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার নিচে। এই ২৪ ঘণ্টায় সেখানে পানি বেড়েছে ৪৪ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া সুরমা নদীর পানি জেলার ছাতকে বিপৎসীমার ওপরে আছে।

নদীর পানি তীর উপচে ঢুকে পড়ছে শহরে। মঙ্গলবার সকালে শহরের লঞ্চঘাট এলাকা থেকে তোলা
ছবি: খলিল রহমান

তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক তিন দিন ধরে বিচ্ছিন্ন আছে। উজানের ঢলে গতকাল আবারও জেলা সদর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আফতাব উদ্দিন জানান, উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর ও শনির হাওরপারের গ্রামগুলো বেশি আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় পাহাড়ি ঢলের প্রবল তোড়ে অনেক রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় দু-একটি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন উঠতে শুরু করেছেন।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সুরমা নদীর তীরবর্তী রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢোকায় দুর্ভোগে পড়েছেন তাঁরা। পৌর শহরের লঞ্চঘাট, জলিলপুর, মল্লিকপুর, উত্তর আরপিননগর, তেঘরিয়া, নবীনগর, ওয়েজখালী, মল্লিকপুর ও বড়পাড়া এলাকায় সুরমা নদীর পারি তীর উপচে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরে প্রবেশ করেছে। গতকাল রাতের ভারী বৃষ্টিতে পানি বেড়েছে বেশি।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানান, শহরে নদী ও হাওরতীরবর্তী এলাকায় পানি ঢুকছে। এসব এলাকায় রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও বাড়িঘরে পানি আছে। বন্যার আশঙ্কায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায়
ছবি: খলিল রহমান

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুনামগঞ্জ ও এর উজানে ব্যাপক বৃষ্টি হওয়ার কারণেই পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। মূলত উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বেশি বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে। এতে সুনামগঞ্জে নদী ও হাওরে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গতকাল দিন ও রাতের বৃষ্টিতে পানি আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে উজানের ঢলও থেমে নেই।

এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দারা আবার বন্যার আশঙ্কা করছেন। শহরের বাসিন্দারা নিজেদের বসতঘর ও দোকানপাটের জিনিসপত্র রক্ষায় তোড়জোড় শুরু করেছেন। অনেকেই নিজের ঘরের জিনিসপত্র কিছুটা উঁচু স্থানে রাখার ব্যবস্থা করছেন। ব্যবসায়ী রিপন শেখ বলেন, ‘ভাই, কোনো ভরসা নাই। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে যেকোনো সময় পানি আসতে পারে। দোকানে পানি ঢুকলে তো সব শেষ।’

বৃষ্টি আরও হবে। এতে পানি আরও বাড়বে। সুনামগঞ্জ এবং এর উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হওয়ার কারণেই মূলত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বড় কোনো বন্যা হবে না।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার

তাহিরপুর উপজেলার জাদুকাটা নদী, সীমান্তের কলাগাঁও, বড়ছড়া ও লাকমাছড়া হয়ে ঢল নামছে। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দু-একটি স্কুলে বিকেলে কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মফিজুর রহমানের নির্দেশে এসব পরিবারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান তানভীর আল আশরাফী চৌধুরী জানান, উপজেলাটির সীমান্তবর্তী ইউনিয়নগুলোয় পানি বেশি বেড়েছে। অনেক সড়ক তলিয়ে যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলে আশঙ্কা তাঁর।

তবে বড় কোনো বন্যার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার। তিনি বলেন, বৃষ্টি আরও হবে। এতে পানি আরও বাড়বে। সুনামগঞ্জ এবং এর উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হওয়ার কারণেই মূলত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বড় কোনো বন্যা হবে না।

আরও পড়ুন

সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন থেকে বন্যা দেখা দেয়। একপর্যায়ে পুরো জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। প্লাবিত হয় জেলার ১ হাজার ১৮টি গ্রাম। আট লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। অসংখ্য ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। মানুষের বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে আশ্রয় নেয় ২৫ হাজার পরিবার। গত ২৩ জুনের পর থেকে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে মানুষ বাড়িঘরে ফেরেন। আবার কেউ কেউ এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি। স্বস্তি ফেরার আগেই আবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।