ঝুঁকিতে সিলেট বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের ৪৪ প্রাণী, অব্যাহতি চান লাপাত্তা ইজারাদার
সিলেটের টিলাগড় এলাকার বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি চিড়িয়াখানা হিসেবে পরিচিত। প্রায় দেড় মাস ধরে সংরক্ষণ কেন্দ্রটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ইজারাদার লাপাত্তা। ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে বন বিভাগ। এরপরও সংরক্ষণ কেন্দ্রে দর্শনার্থীরা অবাধে ঘোরাফেরা করছে। এ কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে সেখানকার বিভিন্ন প্রজাতির ৪৪ প্রাণী।
এদিকে প্রায় দেড় মাস পর বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির আবেদন করেছেন ইজারাদার সুবেদুর রহমান। তিনি সিলেট মহানগর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘অমি এন্টারপ্রাইজ’ সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টিকিট আদায়ের দায়িত্বে ছিল।
সংরক্ষণ কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুবেদুর রহমান সরকারি দলের নেতা হওয়ায় ‘দাপুটে ইজারাদার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দাপট খাটিয়ে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাফেটেরিয়া ইজারা নিয়েছিলেন। ইজারা নিয়ে শুধু নিজেদের ব্যবসার দিকটিই নজর দিয়েছিলেন। প্রাণীদের তদারকিতে গুরুত্ব দেননি তাঁর লোকজন, যার ফলে তাঁর প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নেওয়ার পর সংরক্ষণ কেন্দ্রের দুটি জেব্রা, পাঁচটি ময়ূর, ১১টি কই কার্প মাছ, চারটি খরগোশ মারা গেছে। এ ছাড়া টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য দাবি ও দর্শনার্থীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি সরেজমিনে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, প্রাণীদের জন্য নির্ধারিত খাঁচাগুলোর অবস্থা বেহাল, অপরিচ্ছন্ন। ময়ূরের জন্য খাঁচার ওপর গাছের পাতা ও বৃষ্টির পানি জমে পচে গেছে। রঙিন মাছ ‘কই কার্প’ রাখার জন্য নির্মিত পুলের ভেতর ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল। ওপরে টানানো নেটে জমে রয়েছে গাছের পাতা। তিনটি পাখির খাঁচা খালি পড়ে রয়েছে। সেগুলোর ভেতরে জন্মেছে আগাছা। প্রাণীদের খাবার তৈরির জন্য শেডের টিনের চালা নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া দুটি জেব্রা মারা যাওয়ায় জেব্রার জন্য নির্ধারিত স্থানটি খালি রয়েছে। সম্প্রতি এক দুপুরে ওই শেডের সামনে গরু চড়ে বেড়াতে দেখা গেছে। দর্শনার্থীরা ইচ্ছামতো যাতায়াত করছেন।
সংরক্ষণ কেন্দ্রে প্রাণীদের তদারকি করেন এমন এক কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, ইজারাদার তিন বছর আগে প্রথম ইজারা নেওয়ার সময় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২৯ জন কর্মী নিয়েছিলেন। এর পরের বছর কমতে থাকে। ২ মাস আগে ১২ জন দায়িত্ব পালন করেছেন। যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা প্রাণীদের তদারকির বদলে টিকিট বিক্রিতে বেশি মনোযোগী ছিলেন। দর্শনার্থীরা খাঁচায় রক্ষিত প্রাণীদের অযথা বিরক্ত করেছে, মানব খাবার দিয়ে অসুস্থ করার মতো ঘটনা ঘটেছে। আবার বড় বড় ইট দিয়ে আঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। এসব দেখেননি ইজারাদারের লোকজন।
সুবেদুর রহমান গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর থেকেই আত্মোগোপনে রয়েছেন। এর পর থেকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা তাঁর কর্মীরাও কাজে যাচ্ছেন না। এতে বিপাকে পড়েছে বন বিভাগ। ১১২ একর জায়গা ও বন্য প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন বন বিভাগের মাত্র তিনজন কর্মী।
সংরক্ষণ কেন্দ্রের একজন কর্মী বলেন, এখানে বর্তমানে তিনটি ময়ূর, ২০টি হরিণ, অজগর, চার ধরনের পাখি, মাছ মিলিয়ে ৪৪টি প্রাণী রয়েছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় অনেক দর্শনার্থী ভেতরে প্রবেশ করে। খাঁচায় থাকা প্রাণীগুলোকে কৌতূহল বশত মানব খাবার দিচ্ছে, যা প্রাণীগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আবার কেউ কেউ প্রাণীগুলোকে অহেতুক বিরক্ত করছে। এর মধ্যে সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীদের অগোচরে খাঁচায় থাকা অজগরটি একবার খুঁচিয়ে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। খাঁচার অবস্থা বেহাল হওয়ায় পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বন বিভাগের প্রাণী চিকিৎসক নেই। যার ফলে কোনো প্রাণী অসুস্থ হয়ে পড়লে সে প্রাণীটির জীবন নিয়ে ঝুঁকি দেখা দেয়। জনবল কম থাকায় তারা সার্বক্ষণিক প্রাণী এবং দর্শনার্থীদের নজরদারি করতে পারেন না। নিজেরাও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ইজারাদার সুবেদুর রহমানের ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পটপরিবর্তনের পর ইজারাদারকে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি নিরাপত্তার জন্য সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বুধবার ইজারাদারের পক্ষে লোকজন বন বিভাগে যোগাযোগ করে ইজারা থেকে সরে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। বন বিভাগের পক্ষ থেকে শর্ত অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অপরাগতার কারণে ইজারার কিস্তির টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে।
মো. হুমায়ুন কবির বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ইজারার মেয়াদ ছিল। বন বিভাগের জনবল কম। এরপরও সংরক্ষণ কেন্দ্রটি রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে। জনবল–সংকট কাটিয়ে ইজারাদারকে বাদ দিয়ে শিগগির সংরক্ষণ কেন্দ্রটি চালু ও খাস কালেকশনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
প্রাণীদের মৃত্যু সম্পর্কে হুমায়ুন কবির বলেন, বন বিভাগের কোনো প্রাণী চিকিৎসক নেই। প্রাণীদের অসুস্থতার ক্ষেত্রে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের অধ্যপকসহ অন্যদের অনুরোধ করে সহায়তা নিয়ে থাকেন। সংরক্ষণ কেন্দ্রে প্রাণীদের বসবাসের যেসব খাঁচা তৈরি হয়েছে, সেটি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তৈরি হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পরিবেশ ও প্রাণী অধিকারভিত্তিক সংগঠন ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, রাজনৈতিক দাপটের ইজারাদারির কারণে এ অবস্থা হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবে প্রাণীদের প্রতি মায়াহীন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া আপত্তিকর। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দাপটে ইজারা প্রথা পরিহার করার পরামর্শ দেন তিনি।