লবণাক্ত ঘেরে শর্ষের আবাদ

ঘেরের জমিতে এভাবে যে শর্ষে চাষ করা যায়, তা দেখে এলাকার মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করছেন।

খুলনার পাইকগাছায় কপোতাক্ষ পারে প্রথমবারের মতো শর্ষে আবাদ করা হয়েছে। শর্ষেখেতের সৌন্দর্য দেখতে আসছেন অনেকেছবি: প্রথম আলো

দেশের অন্যতম প্রধান ভোজ্যতেল শর্ষে। তবে এই ফসলটি দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকায় সাধারণত চাষ হয় না। এর কারণ উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি শর্ষের জন্য ভালো। তার ওপর লোনা মাটিতে শর্ষে ভালো হয় না। এ জন্য উপকূলীয় নিচু লবণাক্ত এলাকায় শর্ষেখেতের তেমন দেখাও মেলে না।

তবে এর ব্যতিক্রম করে দেখিয়েছেন খুলনার পাইকগাছার এক চাষি। তিনি এ এলাকায় প্রথমবারের মতো চিংড়িঘেরের ১০ বিঘা জমিতে শর্ষের চাষ করেছেন। এসব শর্ষের ফুলও এসেছে সম্প্রতি। ঘেরের জমিতে এভাবে যে শর্ষে চাষ করা যায়, তা দেখে এলাকার মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করছেন।

এই শর্ষেচাষির নাম গাজী হারুন-অর রশিদ। পাইকগাছার গদাইপুর ইউনিয়নের হিতামপুর গ্রামের কপোতাক্ষ নদের পাড়ে তাঁর বাড়ি। সেখানেই তাঁর মাছের ঘেরের শুকিয়ে যাওয়া জমিতে এখন হলুদ শর্ষের ফুলে মজেছেন স্থানীয় সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ।

পাইকগাছায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে মাছ চাষ করা হয়। এর মধ্যে ৭ হাজার হেক্টর ঘের। ওই ঘেরে যদি এভাবে শর্ষে চাষ করা যায়, তাহলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হবে।
পবিত্র কুমার দাস, উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা, পাইকগাছা

হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘেরের জমিতে শর্ষে চাষের কোনো জ্ঞান তাঁর ছিল না। তবে গত বছর শুকিয়ে যাওয়া ঘেরের জমিতে একটি শর্ষেগাছ বেড়ে উঠতে দেখেন। বড় হয়ে ঝাঁকালো হয় গাছটি। ঘেরের শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে গাছটিতে ফুল-ফল দেখে হারুনের মাথায় শর্ষে চাষের চিন্তা আসে। ঠিক করেন, পরের বছর পরীক্ষামূলকভাবে ঘেরের কিছু জমিতে শর্ষের চাষ করবেন। এবার নভেম্বরের দিকে ঘের থেকে মাছ তোলেন তিনি।

ডিসেম্বরের শুরুর দিকে পানি শুকিয়ে গেলে অনলাইন থেকে সাতক্ষীরা কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের খোঁজ পান। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা বিনা-৯ জাতের শর্ষেবীজ বপনের পরামর্শ দেন। ওই জাতের বীজ কিছুটা লবণসহিষ্ণু, রোগবালাই প্রতিরোধক্ষমতাও বেশি। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে হালকা ভেজা ঘেরের মাটিতে বিনা-৯ জাতের শর্ষেবীজ ছড়িয়ে দেন হারুন। ১০ বিঘা জমিতে তিনি ২৯ কেজি বীজ বপন করেছেন। এর মধ্যে ১০ কেজি বিনা মূল্যে দিয়েছে সাতক্ষীরা কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।

হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ওই জমিতে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ করে আসছেন। বছরের প্রায় ৯ মাস লবণপানিতে তলিয়ে থাকে চিংড়িঘেরটি। মাছ আহরণের পর পানি শুকিয়ে ফেলা হয়। এরপর দুই থেকে তিন মাস পতিত পড়ে থাকে জমি। মাটিতে একটু জো (ভেজা) থাকতেই তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন শর্ষের বীজ। এ জন্য জমি চাষ করার প্রয়োজন হয়নি। তবে শর্ষে হবে কি না, এমন সন্দেহে ছিলেন। তিনি বলেন, অনভিজ্ঞতার কারণে শর্ষে যে সময় বপন করতে হয়, এর চেয়ে ১৫-২০ দিন দেরিতে বপন করেছেন তিনি। এ কারণে ফলন কিছুটা কম হতে পারে। এরপরও প্রথম বছরেই ভালো ফলন পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, হিতামপুর কপোতাক্ষ নদের দুই পারে শত শত বিঘা জমি শুকিয়ে যাওয়ায় মাটি সাদা হয়ে আছে। এই জমিগুলোতে ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে নদী থেকে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ করেন ঘের মালিকেরা। এই ঘেরগুলোর মধ্যেই রয়েছে হারুনের ঘেরটি। হলুদের আভা ছড়াচ্ছে তাঁর শর্ষেখেত। পুরো খেত হলুদ শর্ষে ফুলে ভরে গেছে, কিছু কিছু গাছে ফলও ধরেছে। হলুদের সমারোহ দেখতে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক মানুষ ভিড়ও করছেন সেখানে। তাঁরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলছেন।

হারুনের ঘেরের পাশে ৬২ বিঘার ঘের রয়েছে মো. আমিন উদ্দিনের। ঘেরটি ফাঁকা পড়ে আছে। আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘেরের লবণাক্ত জমিতে শর্ষে হতে পারে, তা আগে কখনো ভাবনাতেও ছিল না। কেউ কখনো দেখেওনি। এখন হারুনের শর্ষে চাষ দেখে আমরাও উৎসাহিত হচ্ছি। আগামী বছর আমি চাষ করব বলে ভাবছি।’

ঘেরের জমিতে এভাবে বিনা চাষে যে শর্ষে চাষ করা যেতে পারে, তা ধারণা ছিল না কৃষি কর্মকর্তাদেরও। এখন তাঁরা নিয়মিত খেতটি পরিদর্শন করছেন ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। পাইকগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পাইকগাছা উপজেলাতেই হাজার হাজার বিঘা লবণপানির মাছের ঘের রয়েছে। মাছ তোলার পর শুকিয়ে ফেলায় বছরের তিন মাস সেগুলো পড়ে থাকে। উদ্যোগটি সফল হলে ওই এলাকায় শর্ষে চাষে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

পাইকগাছা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, পাইকগাছা উপজেলায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে মাছ চাষ করা হয়। এর মধ্যে ৭ হাজার হেক্টর ঘের। ওই ঘেরে যদি এভাবে শর্ষে চাষ করা যায়, তাহলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হবে।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে এর চাষাবাদ করা হয় এবং প্রায় আড়াই লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতের শর্ষের বীজে প্রায় ৪০-৪৪ শতাংশ তেল থাকে। খৈলে প্রায় ৪০ শতাংশ আমিষ থাকে। তাই খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।