‘পদ্মা সেতু থেইক্যা পড়ার পর রাইত ভরই আমি নদীতে ভাসছি’
প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের এক্সিট লেন দিয়ে হঠাৎই একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা উঠে পড়ে সেতুতে। সেই রিকশা নিয়ে চালক সেতুর ওপর ওঠার পর ‘রেলিং থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়ছেন’, এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর কয়েক দিন পদ্মা নদীতে চলে ওই রিকশাচালককে উদ্ধারের অভিযান। তবে তাঁর সন্ধান মেলেনি। তবে গতকাল রোববার পদ্মা সেতুর উত্তর থানায় হাজির হয়ে এক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনিই নিখোঁজ সেই ব্যক্তি। ফেরত চান তাঁর অটোরিকশাটি।
শরিফুল ইসলাম (৩৩) নামের ওই ব্যক্তি গত ১৯ জুন পদ্মা সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দেন বলে যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয় পুলিশ। পরে তাঁকে তাঁর রিকশাটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। রিকশাটি নিয়ে রোববারই বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের উদয়পুর উত্তরকান্দি গ্রামে পৌঁছান তিনি। এখন বাড়িতেই আছেন শরিফুল।
পদ্মা সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। এত উঁচু সেতু থেকে পদ্মার মতো বিশাল নদীতে পড়ে কীভাবে বেঁচে ফিরলেন তিনি, তা জানতে প্রথম আলোর এ প্রতিবেদক গিয়েছিলেন শরিফুলের বাড়িতে। সোমবার দুপুরে গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, বাবার ঘরের পাশে টিনের ছাউনি ও বেড়ার ছোট্ট একটি ঘর। মেঝেটা মাটির। বারান্দায় কাঠের টেবিল এবং টিভি রাখার ভাঙা টেবিল ছাড়া আসবাব বলতে ঘরে আর কিছুই নেই। দেখেই বোঝা যায়, ঘরে কেউ থাকেন না। সেখানে টেবিলের ওপর রাখা অটোরিকশার কয়েকটি ব্যাটারি। পাশে রিকশার সিট, চাকাসহ অন্য মালামাল আলাদা আলাদা করে রাখা।
শরিফুল বলেন, চার-পাঁচ বছর ধরে ঢাকা থাকেন তিনি। রিকশা চালিয়ে চলত তাঁর সংসার। স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার বৌবাজার বালুর মাঠ এলাকায় ভাড়া থাকতেন। হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, শাহবাগ এলাকায় চালাতেন রিকশা। তবে নিজের রিকশা ব্যাটারিচালিত হওয়াতে দিনে না চালিয়ে চালাতেন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।
সেদিন কী হয়েছিল, জানতে চাইলে শরিফুল বলেন, ‘আমি সাধারণত মাগরিবের নামাজ পড়েই রিকশা নিয়ে বের হই। কিন্তু সেদিন বের হই বেশ পরে, ৮টা-সাড়ে ৮টার দিকে। একটু রাগারাগি করেই বের হয়েছিলাম।’
কার ওপর রাগ জিজ্ঞেস করলে শরিফুল বলেন, ‘পরিবারের ওপরও একটু আছে, মহল্লার লোকজনের ওপরও। ভাবছিলাম, একবারে অটো নিয়ে বাড়িতে চলে আসব। সেই নিয়ত করেই রওনা হই। সোজা পদ্মা সেতুতে চলে যাই।’
তারপর কী হলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, উল্টো পাশ দিয়ে সোজা সেতুতে উঠে যান। সেতুর ২১ নম্বর পিলারে একটা বড় গাড়ি থামানো ছিল। এর সঙ্গে মুখোমুখি তিনি রিকশা নিয়ে ধাক্কা খান। তাঁর রিকশাটি অনেক গতিতে চলছিল। ধাক্কা লাগার পর তিনি গাড়ি থেকে পড়ে যান। নিজেকে সামলাতে পারেননি। ফলে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তখন তিনি দৌড়াচ্ছিলেন। পরে সেতুর ওপর থেকে নদীতে পড়ে যান।
শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতু থেইক্যা পড়ার পর রাইত ভরই আমি নদীতে ভাসছি। কোনো কূল পাচ্ছিলাম না। কোথায় আছি, কিছু বুঝতে পারছিলাম না। পানির মধ্যে পড়ে গিয়ে যখন উঠি, সেতুর কিছু একটার রডে গুঁতা লাগে। জিব কেটে যায়। রক্ত বের হচ্ছিল। কোনো কিছু পাইনি। সারা রাত সাঁতার দিয়ে ভাসি। যখন ভোর হলো, তখন ভাসতে ভাসতে ঢাকার দিকের কিনারে উঠছি। কোথায় যে উঠছিলাম, নাম ঠিক বলতে পারছি না। তখন আমি অনেক অসুস্থ। ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলাম না। একটা লুঙ্গি পরা ছিলাম, দেখে পাগলের মতো লাগছিল। পরে লোকজনের কাছ থেকে শুনে শুনে শ্রীনগর থানা হয়ে হাইওয়েতে যাই। সেখান থেকে গোপালগঞ্জে আমার শ্বশুরবাড়িতে যাই। পরে বাড়ি আসি।’
থানায় বা হাসপাতালে না গিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন কেন? প্রশ্ন করলে শরিফুল বলেন, ‘কেউ তো একটা দুর্ঘটনা ঘাড়ে নিতে চায় না। তাই আমি বাড়ি চলে আসছিলাম। আমি সেতু দিয়ে লাফ দিইনি। ধাক্কা লাগার পর ব্যালেন্স রাখতে পারিনি। পড়ে যাই দৌড়ের মতো করে। গায়ের অনেক জায়গাও ছিলে যায়। বাড়ি এসে বলছি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না। অনেক পরে বিশ্বাস করছে, আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি।’
শরিফুলের বড় ভাই মো. মুরশিদ আলম গাজী বলেন, ‘আমরা প্রথমে কেউ বিশ্বাস করিনি। ভাবছি, মিথ্যা কথা বলছে। অত বড় সেতু দিয়ে পড়লে কেউ বাঁচে? পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা একটু একটু বিশ্বাস করি। কাল (গতকাল রোববার) রিকশা নিয়ে এলে বুঝছি, সে মিথ্যা বলছে না।’
শরিফুলের বাবা জিন্নাত আলী গাজী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘শরিফুল প্রথমে শ্বশুরবাড়ি যায়। সেখান থেকে খবর দিলে ছেলেকে গিয়ে নিয়ে আসি। আগস্টে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে শরিফুল। তারপর বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে চিকিৎসা করাই। কিছুদিন খুলনা মেডিকেলেও ভর্তি ছিল। এখন বাড়ি এনেছি।’ কিন্তু শরিফুল বেশি সুস্থ নন। তিনি (জিন্নাত) পেনশনের অল্প কিছু টাকা দিয়ে সংসার চালান। আপাতত ধারদেনা করে ছেলের চিকিৎসা করাচ্ছেন।
পুলিশের ঝামেলা যদি এড়াতেই চেয়েছিলেন, তাহলে অটোরিকশা ফেরত নিতে গেলেন কেন? জবাবে শরিফুল বলেন, রিকশাটি তিনি ঋণ করে এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কিনেছিলেন। ঋণের সব কিস্তি দিতেও পারেননি। এদিকে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে সবাই বলছিলেন, তিনি হয়তো রিকশা বিক্রি করে দিয়েছেন। তাই তিনি রিকশা নিতে থানায় গিয়েছিলেন। রিকশা দেখে সবাই এখন তাঁর কথা বিশ্বাস করছেন।
শরিফুল বলেন, ‘এত উঁচু থেকে পড়ে যে বেঁচে গেছি, আল্লাহই বাঁচাইছে। এখনো বেশ অসুস্থ, আমার তো সেই সামর্থ্য নেই, তাই ভালো চিকিৎসা করাতে পারিনি। কীভাবে যে সুস্থ হব, কবে রিকশা ঠিক করে চালাতে পারব, জানি না।’