গৌরনদীর সাবেক মেয়র হারিছুর গ্রেপ্তার, এলাকায় বিচার চেয়ে মিছিল, মিষ্টি বিতরণ
বরিশালের গৌরনদী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারিছুর রহমানকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সন্ধ্যায় তাঁকে বরিশালের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিচারক ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইউনুস মিয়া এ তথ্য নিশ্চিত করে আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক মেয়র হারিছুর রহমানের বিরুদ্ধে বরিশাল ও গৌরনদী থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে। আজ দুপুরে তাঁকে ঢাকা থেকে বরিশালে আনা হয়েছে। পরে তাঁকে বরিশালের আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাঁর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
হারিছুর রহমান বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে আবুল হাসানাতের ক্ষমতার দাপটে এলাকায় জমি দখল, টেন্ডারবাজি, মার্কেটে তালা দিয়ে বিপুল অর্থ আদায়, বিরোধী দল বিএনপি ও নিজ দলের ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নেতা-কর্মীকে কোপানোর নির্দেশ, পঙ্গু করে দেওয়াসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, হারিছুর ২০০৮ সালে গৌরনদীতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর হাত ধরে রাজনীতি শুরু করেন এবং উপজেলা যুবলীগের সদস্য হন। এরপর হাসানাত আবদুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেই একটি বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। এরপর ২০১০ সালে গৌরনদী পৌরসভায় প্রভাব বিস্তার করে মেয়র হন। এরপর তিনি হাসানাতের আশীর্বাদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান। নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে মাঠ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে হারিছুর ২০১৫ ও ২০২১ সালেও মেয়র নির্বাচিত হন। টানা তিনবার মেয়র থাকাকালে তিনি গৌরনদীর সব উন্নয়ন প্রকল্প, দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ অপকর্মের একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল হারিছুর মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। তাঁর বিপরীতে প্রার্থী হন গৌরনদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মনির হোসেন মিয়া। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই নির্বাচনে হারিছুর বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হন মনির হোসেন মিয়ার কাছে। ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর হারিছুর ও তাঁর বাহিনী এক সপ্তাহ ধরে এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। হারিছুরের নেতৃত্বে তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় হামলা চালিয়ে বিজয়ী চেয়ারম্যান মনির হোসেনের কর্মী-সমর্থকদের ১২টি বসতঘর ভাঙচুর করেন। এ সময় নারীদের শ্লীলতাহানিসহ আমিনুল ইসলাম ওরফে মিরাজ মল্লিক নামের এক যুবককে কুপিয়ে মারাত্মক জখম ও প্রতিবন্ধী এক তরুণীসহ তাঁর বাড়ির প্রায় ১০ নারী-পুরুষকে পিটিয়ে আহত করা হয়। হামলাকারীরা ১৫টি মোটরসাইকেল, দুটি মিনি ট্রাক ও একটি ট্রলি ভাঙচুর করেন বলে ওই সময় অভিযোগ উঠেছিল।
গৌরনদীর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, হারিছুর হাসানাতের আস্থাভাজন হয়ে দলের মধ্যে নিজের ব্যক্তিগত বলয় সৃষ্টি করে গোটা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে তিনি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। উন্নয়ন প্রকল্প, অফিস-আদালত, থানাসহ সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। হারিছুর এতই ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন যে তাঁর কথাই ছিল গৌরনদীতে শেষ কথা।
গৌরনদী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বরিশাল জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা মনিরুন নাহার বলেন, হারিছুর রহমান গত সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। সেই সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। হারিছুর ‘গৌরনদীর দানব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
বিচার চেয়ে মিছিল, মিষ্টি বিতরণ
এদিকে সাবেক মেয়র হারিছুরের গ্রেপ্তারের সংবাদে আজ দুপুর তাঁর বিচার দাবিতে গৌরনদীতে মিছিল করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মী ও ভুক্তভোগীরা। এ সময় তাঁরা আনন্দমিছিল করে মিষ্টি বিতরণ করেন এবং হারিছুরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
আজ দুপুরে গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এই মিছিল হয়। এর বাইরে গৌরনদী পৌর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিয়নেও হারিছুরের গ্রেপ্তারের সংবাদে সাধারণ জনগণ মিছিল বের করেন।
জনতার রোষানল থেকে বাঁচাতে গ্রেপ্তার হারিছুরকে বহনকারী গাড়িবহর ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার প্রধান পথ গৌরনদী এড়িয়ে টেকেরহাট-গোপালগঞ্জ-পিরোজপুর-ঝালকাঠি হয়ে বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে ব্যাপক পুলিশ পাহারায় তাঁকে বরিশালের আদালতে হাজির করে পুলিশ।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বিকেলে পুলিশ হারিছুরকে বরিশালের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিচারক সারা ফারজানা হক তাঁর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।