নওগাঁর টুপির কদর মধ্যপ্রাচ্যে
সংসারের কাজের ফাঁকে অবসরটুকু প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করেই কাটাতেন কুঞ্জবন গ্রামের নারীরা। এখনো তাঁরা একসঙ্গে বসে গল্পে মাতেন। তবে সবার হাতে থাকে সুই-সুতা ও কাপড়। একদিকে চলে একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি, অন্যদিকে সুইয়ের ফোঁড়নে কাপড়ে দৃশ্যমান হয় নান্দনিক নকশা। সেই নকশা করা কাপড়ের তৈরি টুপি পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। বিনিময়ে দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা।
টুপি সেলাইয়ের এই কাজ করে বাড়তি আয়ের দেখা পেয়েছেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের কুঞ্জবন গ্রামের নারীরা। খোসালপুর, ঘোষপাড়া, মধুবন গ্রাম ঘুরেও টুপি তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত দেখা গেছে গ্রামের নারীদের। ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, মহাদেবপুর, মান্দা ও নিয়ামতপুর উপজেলার প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি গ্রামের নারীরা এই কাজে যুক্ত। সারা বছর টুপি সেলাইয়ের টুকটাক কাজ হলেও রমজান মাস এবং দুই ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ততা বেড়ে যায় স্থানীয় কারিগর ও ব্যবসায়ীদের। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে এসব টুপির চাহিদাও ব্যাপক।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্দিষ্ট নকশার ওপর নওগাঁর নারীরা নানা রঙের সুতায় যে টুপি বুনে চলেছেন, তা ওমানের জাতীয় টুপি হিসেবে স্বীকৃত; যা ‘কুপিয়া’ নামে পরিচিত। হাতে তৈরি এসব টুপির প্রধান বাজারও ওমান। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত ও কাতার এবং আফ্রিকা মহাদেশের দেশ তানজানিয়া ও মরক্কোর বাজারেও রপ্তানি হয় এসব টুপি।
পথ দেখালেন তায়েজ উদ্দিন
কারিগর, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক যুগ আগে ফেনী থেকে আসা ব্যবসায়ী তায়েজ উদ্দিন কুঞ্জবন গ্রামের নারীদের টুপিতে নকশা তৈরির কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। শুরুতে গুটিকয় আগ্রহী নারীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নকশা তৈরির কাজ শুরু হয়। তাঁদের বাড়তি আয় দেখে কুঞ্জবন ও আশপাশের গ্রামের অন্য নারীরাও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মহাদেবপুর উপজেলার সদর, খাজুর, উত্তরগ্রাম, চান্দাশ, হাতুড় ও রাইগাঁ ইউনিয়ন; মান্দা উপজেলার ভালাইন, গণেশপুর, মান্দা সদর ও পরানপুর ইউনিয়ন; নিয়ামতপুর উপজেলার সদর, চন্দননগর, হাজীনগর ও ভাবিচা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে টুপিতে নকশা তৈরির কাজ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে টুপি তৈরির কাজের সঙ্গে প্রায় ১৫০ জন ব্যবসায়ী জড়িত। নারী কারিগর যুক্ত আছেন প্রায় ৭০ হাজার।
তায়েজ উদ্দিন মহাদেবপুর টুপি ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে টুপি রপ্তানি করেন। মহাদেবপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ওই রপ্তানিকারকদের কাছে টুপি সরবরাহ করেন। গত বছর নওগাঁ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার টুপি বিক্রি হয়েছে। এ বছর ২৫০ কোটি টাকার টুপি বিক্রির আশা করছেন তাঁরা।
যেভাবে তৈরি হয় নান্দনিক টুপি
এক থান কাপড় থেকে প্রকারভেদে ৯০ থেকে ১০০টি টুপি তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। টুপির প্রাথমিক কাজ করেন সেলাই মাস্টার ও প্রিন্টিং মাস্টাররা। কুঞ্জবন এলাকার বাসিন্দা স্বাধীন ইসলাম এই প্রিন্টিং মাস্টারের একজন। তিনি জানান, কাপড়ের থান থেকে টুপি মাপমতো কাটার পর মেশিনে প্রাথমিক সেলাইয়ের কাজ করা হয়। এরপর ওই কাপড়ে ট্রেসিং পেপার, তেল ও ব্লুর (নীল) সাহায্যে বিভিন্ন প্রিন্ট (নকশা) করা হয়। প্রতিটি টুপি সেলাইয়ের কাজের জন্য আড়াই টাকা এবং প্রিন্টের জন্য আড়াই টাকা মজুরি পান তাঁরা। এরপর কাপড়গুলো গ্রামে গ্রামে নারী কারিগরদের কাছে পৌঁছে দেন ব্যবসায়ীদের মাঠকর্মীরা (এজেন্ট)।
ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ ধরনের এ টুপিতে মূলত চেইন, দেওয়ান, বোতাম, গুটি দানা ও মাছের কাঁটা নামের ছয় ধরনের নকশা হয়ে থাকে। প্রতিটি টুপিতে থাকে আলাদা আলাদা নকশা। কারিগরদের পারিশ্রমিকের তারতম্য হয় কাজের মান ও গুণের ওপর।
১০ বছর ধরে টুপির ব্যবসা করছেন কুঞ্জবন গ্রামের মাজহারুল ইসলাম। তিনি জানান, সুই-সুতায় নকশা তোলার কাজ শেষে টুপির কাপড়গুলো নিয়ে এসে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিটি টুপি ৪০০ থেকে ২ হাজার টাকা দামে তাঁরা বিক্রি করেন। তাঁর মতো ছোট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে যাঁরা টুপি কিনে নেন, তাঁরা আবার সেগুলো চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লার ব্যবসায়ীদের কাছে লাভে বিক্রি করেন।
সুই-সুতায় নারীদের স্বাচ্ছন্দ্য
মহাদেবপুর সদর ইউনিয়নের খোসালপুর গ্রামের গৃহবধূ আশা বেগম (৪০)। ১০ বছর আগে বিয়ে হয়ে গ্রামে আসার পর থেকেই তিনি দেখছেন নারীরা টুপিতে নকশা তোলার কাজ করছেন। বাড়তি আয়ের আশায় তিনিও এ কাজে জড়িয়ে পড়েন। আশা বেগম বলেন, সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুপিতে নকশা তোলার কাজ করে সপ্তাহে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করেন তিনি। গ্রামে তাঁর মতো আরও ৮০ থেকে ৯০ জন নারী এ কাজে জড়িত।
নারীরা জানান, নকশাভেদে প্রতি টুপিতে ১৬ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। ১৬ টাকার একটি টুপির কাপড়ে নকশা তুলতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে একেকজন দিনে ৫-৬টি টুপির কাজ করতে পারেন। সবচেয়ে বেশি সময় ও পরিশ্রম হয় দানা সেলাইয়ে। একেকটি টুপির নকশা করতে ১০-১৫ দিন লাগে। মজুরি পাওয়া যায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
মহাদেবপুরের টুপির বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন মধুপুর গ্রামের সুজন হোসেন। এবার ঈদুল ফিতরের আগে তিনি ১৫ লাখ টাকার টুপির ফরমাশ পেয়েছেন। আশা করছেন, এ বছর ৫০-৬০ লাখ টাকার টুপি বেচাকেনা হবে। তিনি বলেন, কুপিয়া টুপির ব্যবসা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। আগে ফেনী ও নোয়াখালী থেকে টুপির কাপড়, সুতা ও নকশা করে নিয়ে আসতে হতো। এখন স্থানীয় পর্যায়েই সব উপকরণ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁর অধীনে বর্তমানে ২০ জন এজেন্ট কাজ করেন। একেকজন এজেন্টের অধীনে ৫০০ থেকে ১ হাজার জন নারী কারিগর টুপি সেলাইয়ের কাজ করেন।
কুঞ্জবন গ্রামের ঈদগাহপাড়ার গৃহবধূ জুলেখা বেগম বলেন, যে পরিমাণ পরিশ্রম, তার তুলনায় মজুরি কমই পান। সারা দিনে ৫-৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করে ১০০-১৫০ টাকা মজুরি পান। আরেকটু বেশি হলে আরও বেশি আয় হতো তাঁদের।
মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা টুপি সেলাই করে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রচেষ্টার তুলনা হয় না। এটা সত্যই একটা দৃষ্টান্ত। তবে নারীরা মজুরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কি না, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
বাড়তি আয়ের কারণে সংসারে নারীদের মর্যাদা বাড়ছে উল্লেখ করে মহাদেবপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রাবেয়া রহমান বলেন, গ্রামের নারীদের অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই। টুপির কাজের মাধ্যমে নারীরা সংসারে কিছুটা হলেও আর্থিক সাহায্য করতে পারছেন। প্রত্যন্ত গ্রামে এটা অনেক বড় ব্যাপার।