একদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তি চান, অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চান কিশোরগঞ্জ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আখতারুজ্জামান। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় পাকুন্দিয়া সদর ঈদগাহ মাঠে এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি স্লোগান দেন, ‘মুক্তি চাই, মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই।’
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে প্রায় সব সভাতেই খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে আসছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা আখতারুজ্জামান। একই সঙ্গে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নানা সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। নেতৃত্বের প্রশংসা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। স্থানীয় অনেকের ভাষ্য, আখতারুজ্জামান এসব কথা বলে একদিকে বিএনপির সমর্থকদের ভোটে টানার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে আওয়ামী লীগের অনুগ্রহের আশা করছেন। তবে তাঁর এ ধরনের কথাবার্তায় বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
গতকাল পাকুন্দিয়া সদর ঈদগাহ মাঠের জনসভায় আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আজ আমার জনসমাবেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববাসীর কাছে বলতে পারবেন, বাংলাদেশে অন্তত কটিয়াদী-পাকুন্দিয়াতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। তারপরও যদি কারসাজি করেন, ঘরে ঘরে আগুন লাগবে।’
আখতারুজ্জামানের বক্তব্যকে হাস্যকর মনে করেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও পাকুন্দিয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র জালাল উদ্দীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলের বিরোধিতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে যতই স্লোগান দেন না কেন, বিএনপির একটি ভোটও পাবেন না। কারণ, বিএনপি যেখানে এ নির্বাচন বয়কট করে ভোট বর্জনের আহ্বান করছে, সেখানে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর আখতারুজ্জামান যেখানে খালেদা জিয়ার মুক্তির স্লোগান দিচ্ছেন, সেখানে আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাইছেন, বিষয়টি অনেক হাস্যকর।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী পুলিশের সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ। তিনি আখতারুজ্জামানের বক্তব্যকে ‘বিকৃত’ উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, আখতারুজ্জামান তাঁর দেশমাতার মুক্তি চান, আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আওয়ামী লীগের দোয়া চান। দুর্নীতির দায়ে যেই দেশমাতা অভিযুক্ত, তাঁর মুক্তি দাবি করেন। উনি সব কাজই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে করছেন, আবার দোয়াও নিচ্ছেন শেখ হাসিনার। কত বিকৃত কথা! মনে হচ্ছে, দেশের মানুষ এসব বোঝেন না।’
এ নিয়ে কটিয়াদীর গচিহাটা এলাকার আরিফুর রহমান নামের এক ভোটার বলেন, আখতারুজ্জামান মনে হয় নির্বাচনের কৌশলের জন্য সব পক্ষের সমর্থন পেতে এসব কথা বলছেন। তাঁর এলোমেলো কথাবার্তায় ভোটারদের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনটি কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। আগে আসনটি শুধু কটিয়াদী উপজেলা নিয়ে ছিল। সে সময়ে আখতারুজ্জামান বিএনপির মনোনয়নে দুবার সংসদ সদস্য হন। তবে শুরু থেকেই দলীয় মতের বাইরে গিয়ে নানা কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচিত ছিলেন তিনি। যে কারণে দল থেকে তাঁকে পাঁচবার বহিষ্কার করা হয়। এই আসনে বিএনপির তেমন শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায় আবারও তাঁকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু তারেক রহমানসহ দলের নানা সমালোচনার কারণে বারবার তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। বর্তমানেও তিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। এবারের দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। পাশাপাশি বিএনপি নির্বাচনে না আসায় তীব্র সমালোচনা করেন।
এদিকে আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। সম্প্রতি আখতারুজ্জামানের ট্রাক প্রতীকের সমর্থন দেওয়ায় তাঁকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। নূর মোহাম্মদের দাবি, আখতারুজ্জামানকে তাঁর কাছে অন্য প্রার্থীদের তুলনায় যোগ্য মনে হওয়ায় সমর্থন দিয়েছেন। আবার এ সম্পর্কে আখতারুজ্জামানের দাবি, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নূর মোহাম্মদকে তাঁর পক্ষে নির্বাচন করতে বলায় নূর মোহাম্মদ তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। এ ঘটনার পর থেকে আখতারুজ্জামানের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় নূর মোহাম্মদের অনুসারীদেরও দেখা যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সমর্থিত নৌকার প্রার্থী সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ বর্তমান সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদকে ‘মীরজাফর’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘মনোনয়ন পাওয়ার পরই আমি ওনার বাড়িতে যাই, তখন তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন আমার পক্ষে কাজ করার। কিন্তু এখন তিনি বিএনপির বহিষ্কৃত নেতার ট্রাক প্রতীককে সমর্থন দিয়ে মীরজাফরি করেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা প্রচার করছেন, এ আসন নাকি ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী আখতারুজ্জামানকে দেওয়া হয়ে গেছে, যা সম্পূর্ণ ভুয়া ও ভিত্তিহীন কথা।’
গতকাল রাতে কটিয়াদীর বনগ্রাম এলাকায় অনুষ্ঠিত পথসভায় আবদুল কাহার সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘আপনি নৌকার এমপি হয়ে ট্রাকে উঠেছেন। অথচ এখনো উনি আওয়ামী লীগের এমপি। এটা চিন্তা করা যায়!’ এ সময় আবদুল কাহার আরও অভিযোগ করেন, গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে তাঁর লোকজনকে ধরে নিয়ে ট্রাকের পক্ষে কাজ করতে বলা হচ্ছে। তিনি বিষয়টি নির্বাচন কমিশনসহ জেলা আওয়ামী লীগকে অবহিত করেছেন। জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই নির্বাচনে তো আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে। স্বতন্ত্র তো আর সরকার গঠন করতে পারবে না। তাই নৌকার বিরোধিতা করে কেউ পার পাবে না।
এ আসনে ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন সাবেক সংসদ সদস্য মো. সোহরাব উদ্দিন। তিনি পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। তিনিও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে শুরু থেকেই তিনি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন দুই উপজেলায়। তিনি বলেন, এ আসনের নির্বাচন নিয়ে অনেক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, যদি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন হয়, তাহলে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন।
এমন অবস্থায় ভোটারদের ধারণা, এ আসনে এবার ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। আসনটিতে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মো. বিল্লাল হোসেন (বিএনএফ), মীর আবু তৈয়ব মোহাম্মদ রেজাউল করিম (গণফ্রন্ট) ও আলেয়া (ন্যাশনাল পিপলস পার্টি)।