সুগন্ধিয়া পশুর হাটে দিতে হয় না খাজনা, ভিড় লেগে থাকে ক্রেতা–বিক্রেতার
ঝালকাঠি সদরের বিনয়কাঠী ইউনিয়নের সুগন্ধিয়া পশুর হাটে শত বছর ধরে কোনো খাজনা ছাড়াই পশু বেচাকেনা করে আসছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। একটি মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই হাট কখনো ইজারা দেয় না প্রশাসন, পরিচালনায় নেই কোনো কমিটিও। তারপরও হাটের দিনে জমজমাট বেচাকেনা চলে এখানে।
সরেজমিনে গত মঙ্গলবার সকালে সুগন্ধিয়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, বড় ও মাঝারি আকারের হরেক রকম গরু বিক্রির জন্য তুলেছেন স্থানীয় খামারি ও যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলের ব্যাপারীরা। দেশি-বিদেশি ষাড়ের পাশাপাশি গাভি, বলদ, বাছুরও এ হাটে ওঠানো হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির ছাগলও উঠেছে চোখে পড়ার মতো। গরু-ছাগলের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও এ হাটে পাওয়া যায়।
সুগন্ধিয়া হাটটি ঝালকাঠি-বরিশালের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এর ফলে দুই জেলারই ক্রেতা-বিক্রেতা ও ব্যাপারীরা এখানে পশু কেনাবেচা করতে আসেন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসে।
ক্রেতা–বিক্রেতা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ হাটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে কোনো ইজারাদার নেই। পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো কমিটিও নেই। ক্রেতা-বিক্রেতারা কোনো ধরনের খাজনা ছাড়াই পশু কেনাবেচা করতে পারেন। এর ফলে প্রতিবছর কোরবানিতে এ হাটের প্রতি তাঁদের আগ্রহ বেশি থাকে। তবে কোরবানির বেচাবিক্রি এখনো পুরোপুরি জমে ওঠেনি।
হাটটি শত বছরের প্রাচীন বলে জানালেন সুগন্ধিয়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ফারুক সরদার (৭৫)। তিনি আরও বলেন, প্রাচীন এ হাটে একিন শাহ এর মাজারের প্রতি সম্মান রেখে বেচাকেনায় কোনো খাজনা রাখা হয় না। তাই একটু কম দামের আশায় এখানে ক্রেতাদের সমাগম ঘটে। তবে সাপ্তাহিক হাটের তুলনায় কোরবানির হাটে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় থাকে।
জনশ্রুতি আছে, ধর্ম প্রচারের জন্য সুদূর ইয়েমেন থেকে এ সুগন্ধিয়ায় এসেছিলেন একিন শাহ ও শাহাদাৎ শাহ নামের দুই ভাই। তাঁরা হজরত শাহ জালাল (র.)-এর সঙ্গে আসা সুফি সাধকদের দলের সদস্য ছিলেন। সুগন্ধিয়ায় তাঁদের মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর পয়লা অগ্রহায়ণে এখানে মেলা হয়। এতে ভিড় করেন তাঁদের ভক্ত–অনুসারীরা। যুগ যুগ ধরে এ মাজারকে কেন্দ্র করে হাট বসছে।
ঝালকাঠি-বরিশাল শহরের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ও মাংস ব্যবসায়ী এই হাট থেকেই পশু ক্রয়-বিক্রয় করেন বলে জানালেন সুগন্ধিয়া গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিক হোসেন (৫৫)। তিনি বলেন, সপ্তাহে দুই দিন গরু, ছাগল, হাস-মুরগি ও কবুতরের বিশাল জমজমাট হাট বসে এখানে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পরিচলনা কমিটি না থাকায় গরুর ফড়িয়া বা ব্যাপারীরা নিজ দায়িত্বে হাটে বাঁশ বেঁধে সারি করে রাখেন। হাটের দিন সকাল থেকে বিক্রেতারা সেই বাঁশের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে গরু বেঁধে রাখেন। হাটের উন্নয়নের জন্য বিনয়কাঠী ইউনিয়ন পরিষদ সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়া বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা সহায়তা করে থাকেন। এই হাটে স্থানীয় বাসিন্দাদের দোকানপাট রয়েছে। এসব দোকানপাটের জমির মালিক স্থানীয় সাধারণ মানুষ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হাটের শান্তি-শৃঙ্খলা ও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখেন। গরু বেচাবিক্রি হলে অনেক ফড়িয়া ও বিক্রেতা কিছু টাকা মাজার ও মসজিদে দান করে থাকেন।
বিনয়কাঠী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ জে এম মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথাগতভাবে ও মাজরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে উপজেলা প্রশাসন এই হাটটিকে যুগ যুগ ধরে ইজারার আওতার বাইরে রেখেছে।
বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকার গরু বিক্রেতা হাকিম ব্যাপারী এসেছিলেন সুগন্ধিয়া হাটে। তিনি বলেন, অন্যান্য হাটে প্রতি এক লাখ টাকার গরু বিক্রিতে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা খাজনা দিতে হয়। এই হাট থেকে গরু কিনলে খাজনার প্রয়োজন হয় না। তাই এখান থেকে ১০টি গরু কিনে অন্যত্র বিক্রি করলে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেশি লাভ হয়।
আবদুল আজিজ (৫০) নামের এক গরু বিক্রেতা জানান, এ বছর গোখাদ্যের দাম অস্বাভাবিক থাকায় ক্রেতাদের বাড়তি দামে গরু কিনতে হবে। আকারভেদে একটি বড় সাইজের গরুর দাম পড়বে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। আর মাঝারি সাইজের গরুর দাম পড়বে এক থেকে দুই লাখ টাকা। শেষ দিকে এ হাটে বেচাকেনা জমে উঠবে বলে মনে করেন এই বিক্রেতা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছাহেব আলী বলেন, জেলায় চাহিদার তুলনায় বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। কোরবানির পশুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে ভারতের অবৈধ গরু হাটে যেন প্রবেশ করতে না পারে, সেই দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।