নওগাঁর দুই আসনে যে কারণে হারলেন নৌকার প্রার্থী

এস এম ব্রহানী সুলতান মামুদ, নাহিদ মোর্শেদ, ওমর ফারুক ও আনোয়ার হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং নেতা-কর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে দূরত্বের কারণে নওগাঁ–৪ ও ৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা বলেন, দুটি আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের শক্তিশালী নেতারা স্বতন্ত্র হিসেবে মাঠে ছিলেন। ফলে ভোট ভাগাভাগি হওয়ায় তাঁদের জয় পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়।

মান্দা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-৪ নির্বাচনী এলাকা। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক। সদ্য অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনেও তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়ে দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দল থেকে এবার মনোনয়ন পান মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাহিদ মোর্শেদ। ইমাজ উদ্দিন, নাহিদ মোর্শেদসহ মোট ১২ জন নওগাঁ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে সাবেক সংসদ সদস্য ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক এস এম ব্রহানী সুলতান মামুদ ও মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আফজাল হোসেন নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

ভোটে নৌকার প্রার্থী নাহিদ মোর্শেদ স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্রহানী সুলতান মামুদের কাছে ২৩ হাজার ৪৮ ভোটে পরাজিত হন। আর ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক পান ১১ হাজার ১৯০ ভোট। কাঁচি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আফজাল হোসেন পেয়েছেন ৩৭৫ ভোট।

মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, ২০২১ সালে নাহিদ মোর্শেদ মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। এর পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিদের পদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়ায় তাঁর ওপর নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। এসব কারণেই মান্দা উপজেলার মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে রায় দেন।

নাহিদ মোর্শেদের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন মান্দা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘দলের মধ্যে অনেক নেতা-কর্মী ওপরে ওপরে আমাদের পক্ষে থাকার অভিনয় করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কাজ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে। এ ছাড়া প্রশাসনের লোকজনও অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন। প্রধানত এসব কারণেই আমাদের প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে বলে আমার ধারণা।’

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক উপকমিটির সদস্য শফিকুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালে ষষ্ঠবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক অসুস্থতার কারণে বেশির ভাগ সময় ঢাকাতে ছিলেন। পাঁচ বছরে ছয় মাসও তিনি এলাকায় থাকেননি। এর ফলে সাধারণ মানুষ ও নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। জনবিচ্ছিন্নতার কারণে তিনিও ভোট কম পেয়েছেন।

নওগাঁ-৬ (রানীনগর ও আত্রাই) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন। ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুকের কাছে ৬ হাজার ৭৫৬ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন তিনি। ওমর ফারুক ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পেয়েছেন ৭৬ হাজার ৭১৭ ভোট। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭১ ভোট। আসনটি থেকে আরও দুজন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কাঁচি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নওশের আলী। তিনি ভোট পান ২ হাজার ২৪৩ ভোট। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম ঈগল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩৩১ ভোট।

আরও পড়ুন

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের মৃত্যুতে নওগাঁ-৬ আসন শূন্য হলে ২০২০ সালে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হন আনোয়ার হোসেন। উপনির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া রানীগনর ও আত্রাই উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের কমিটিতে পদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এতে ক্ষুব্ধ হন জ্যেষ্ঠ নেতারা। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্বের কারণে দলের অনেককে প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুকের পক্ষে ভোটে প্রচারণা চালান।

আনোয়ার হোসেনের পক্ষে কাজ করেছেন আত্রাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্কাস আলী। তিনি বলেন, পরাজয়ের পেছনে অবশ্যই কিছু না কিছু ভুলত্রুটি আছে। যে ব্যক্তি যত বেশি কাজ করেন, তাঁর ভুল করার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে। নৌকার প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ কী, তা এখনো পুরোপুরি মূল্যায়ন করা যায়নি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত মূল্যায়ন আরও পরে জানানো হবে।

আরও পড়ুন

আত্রাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী গোলাম মোস্তফা বলেন, আনোয়ার হোসেন মাত্র তিন বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ তিন বছরেই তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ সময়ের মধ্যে তাঁর ছেলেমেয়েরা শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে মানুষ তাঁকে আর বেছে নেননি। এ ছাড়া দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা তাঁর কাছে মূল্যায়ন পাননি। অন্যদিকে ওমর ফারুক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা ওহিদুর রহমান রানীনগর-আত্রাইয়ের সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি সব সময়ই মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এবার ভোটে আঞ্চলিকতা একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। আত্রাই উপজেলার মানুষ হিসেবে ওমর ফারুক আত্রাইয়ের ভোটকেন্দ্রগুলোতে বেশি ভোট পেয়েছেন। আর রানীনগরে বেশি ভোট পেয়েছেন আনোয়ার হোসেন।