দোকানটির প্রধান আকর্ষণ ‘গার্লফ্রেন্ড গোলাপী’ আর ‘ব্রেকআপ মধু’ মালাই চা

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর ইউনিয়নের মোকামবাজারে আবদুল ওয়াহিদের চায়ের দোকানছবি: প্রথম আলো

কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি গ্রামের বাজারে ছোটখাটো চায়ের দোকান। সন্ধ্যার পর সেখানে চা পানের জন্য ভিড় লেগে যায়। দোকানটিতে চা বিক্রি হয় বিচিত্র সব নামে। এর মধ্যে আছে ‘গার্লফ্রেন্ড গোলাপী মালাই চা’, ‘ব্রেকআপ মধু মালাই চা’। এমন নাম শুনে অনেকেই কৌতূহলের বশে দোকানটিতে ঢুঁ মারেন।

এই দোকানের নাম ‘আল্লার হাওলা টি স্টল’। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর ইউনিয়নের মোকামবাজারে এই দোকানের অবস্থান। এটির মালিকের নাম আবদুল ওয়াহিদ (৪৯)। সম্প্রতি মোকামবাজারে গিয়ে কথা হয় আবদুল ওয়াহিদের সঙ্গে। বাজারে তাঁকে সবাই বাউল ওয়াহিদ নামে চেনেন।

আবদুল ওয়াহিদ বলেন, আগে তিনি বাউলগান করতেন। মৌলভীবাজারে পল্লি বাউল নামের একটি বাউল দলে ছিলেন তিনি। তাঁর গানের ওস্তাদ রানু সরকার। বাউল দলে তাঁর নাম ছিল ওয়াহিদ দেওয়ান। গান করে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। তাই জীবিকার তাগিদে আট বছর ধরে বাউল দল থেকে অনেকটা দূরে আছেন। তবে পুরোপুরি দলের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। এখনো ভালো কোনো দাওয়াত পেলে বাউলগানের দলের সঙ্গে যান।

মোকামবাজারের আবদুল ওয়াহিদের চায়ের দোকানে বিভিন্ন ধরনের চায়ের স্বাদ পান চা-প্রেমীরা। তাঁর দোকানে সাধারণ চায়ের সঙ্গে থাকে চালের গুঁড়া, ভুট্টার গুঁড়া, তিলের গুঁড়া, নারকেল দুধ–চা, বাদামি দুধ–চা, স্পেশাল কিশমিশ–চা। এ ছাড়া দুধও পাওয়া যায় দোকানে। চায়ের দাম ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি গ্লাস দুধ বিক্রি করেন ৪০ টাকায়। দোকানে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার বিক্রি করেন।

‘গার্লফ্রেন্ড গোলাপী মালাই চা’ ‘ব্রেকআপ মধু মালাই চা’ এর নামকরণ প্রসঙ্গে আবদুল ওয়াহিদ বলেন, বিচিত্র নাম দিলে ক্রেতাদের আকর্ষণ বাড়ে। এ জন্য তিনি এমন নাম দিয়েছেন। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাকি নামগুলো রেখেছেন। এর ফলে সাড়াও পাচ্ছেন ভালো। শিশু থেকে তরুণ এবং বৃদ্ধ বয়সের ক্রেতারা তাঁর দোকানে নিয়মিত চা পান করেন। দূরদূরান্ত থেকে চলে আসেন অনেকে।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর চা পানের জন্য ভিড় লেগে থাকে আল্লার হাওলা টি স্টলে
ছবি: প্রথম আলো

এর প্রমাণ পাওয়া গেল চায়ের দোকানে বসে। রাত আটটার দিকে বাজারে মানুষ বাড়তে থাকলে আবদুল ওয়াহিদের দোকানেও ভিড় বাড়তে থাকে। সেখানে চালের গুঁড়ার চা পান করছিলেন সিলেট নগরের রায়নগর এলাকার বাসিন্দা সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, সিলেট থেকে মৌলভীবাজারে যাওয়া–আসার পথে প্রায়ই মোকামবাজারে আবদুল ওয়াহিদের চায়ের দোকানে যান। চালের গুঁড়া, ভুট্টার গুঁড়া, ভুট্টার কফি–চা, তিলের গুঁড়া, নারকেল দুধ–চা পান করেছেন, তবে গার্লফ্রেন্ড গোলাপী মালাই চা’ ও ‘ব্রেকআপ মধু মালাই চা’ এখনো পান করা হয়নি। ইচ্ছা আছে এ দুটি চায়ে চুমুক দেওয়ার।

মৌলভীবাজারের বাসিন্দা সৌমিত্র দেব বলেন, ‘গার্লফ্রেন্ড গোলাপী মালাই চা’ ‘ব্রেকআপ মধু মালাই চা’ তিনি পান করেছেন, ভালোই লেগেছে। প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে চা পান করতে আসেন দোকানটিতে। তাঁর মতো অনেকেই আসেন।

প্রেমনগর চা–বাগান এলাকার বাসিন্দা মসব্বির মিয়া বলেন, বাজারে এলে ওয়াহিদের দোকানে চা পান করেন তিনি। চালের গুঁড়া দিয়ে চা পান করলে খিদে মিটে যায়। বাজারে ভাজাপোড়া খাওয়ার চাইতে এ চা তাঁর বেশি ভালো লাগে।

আবদুল ওয়াহিদ তাঁর পরিবার সম্পর্কে বলেন, স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে এবং মাকে নিয়ে তাঁর সংসার। মেয়ে স্নাতক এবং এক ছেলে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করছেন। ছোট ছেলে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর বাবা মারা গেছেন প্রায় বছর ১০ আগে। ওয়াহিদ একসময় বাউলগানের পাশাপাশি চা বিক্রির একটি ছোট দোকান দিয়েছিলেন। তবে সে সময় ব্যবসা তাঁকে টানত না। বাউলগান নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ব্যবসা যখন হওয়ার কথা, তখন তিনি গানের আসরে চলে যেতেন। কিন্তু একসময় দেখলেন, সংসারে অভাব অনটন, বাউলগানেও তেমন কিছু করতে পারছিলেন না, তখন ব্যবসায় মনোযোগ দেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি চালের গুঁড়া, ভুট্টার গুঁড়া চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করছেন। এর পর থেকে গ্রাহক বাড়তে থাকে।

ওয়াহিদ বলেন, ‘গার্লফ্রেন্ড গোলাপী মালাই চা’, ‘ব্রেকআপ মধু মালাই চা’ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি করেন। বেশ কিছু উপকরণ দিতে হয় বলে দামও বেশি। এর মধ্যে চাল, ভুট্টার গুঁড়া থেকে শুরু করে মধু, বাদামের মিশ্রণ থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে তাঁর দোকান। এ সময়ের মধ্যে শত শত কাপ চা বিক্রি করেন তিনি।