আজ একুশে ফেব্রুয়ারি
পাঁচুয়া থেকে জব্বার নগর
ভাষাশহীদ জব্বারের স্মৃতিবিজড়িত এ গ্রামে রয়েছে একটি শহীদ মিনার, ভাষাশহীদের নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি পাঠাগার ও জাদুঘর।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে ভালুকায় যাওয়ার সড়কটি কয়েক বছর আগেও ছিল বেহাল। এখন মসৃণ সড়ক। আঞ্চলিক এ মহাসড়ক দিয়ে ভালুকার দিকে যাওয়ার কয়েক কিলোমিটার পর হঠাৎ চোখ আটকে যায় বাঁ পাশে সরু একটি পাকা সড়কের দিকে, যার প্রবেশমুখে বিশাল এক ফটক। ফটকে বড় বড় করে লেখা ‘ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার নগর’। ফটকে আবদুল জব্বারের ছবি, অন্যদিকে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
ফটকের নিচ দিয়ে যাওয়া সরু সড়কটি ধরে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরের পাঁচুয়া গ্রামটির নাম এখন ‘ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার নগর’। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন ‘জব্বার নগর’। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এলাকায় সংগ্রামী জনতার সমাবেশে যোগ দেন আবদুল জব্বার। সমাবেশের পর মিছিলেও ছিলেন তিনি। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে আবদুল জব্বার মারা যান।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে আবদুল জব্বার ১৯১৯ সালের ১০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম হাছেন আলী এবং মায়ের নাম সাফাতুন নেছা। তিনি ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে দেন। এরপর জব্বার তাঁর বাবাকে কিছুদিন কৃষিকাজে সাহায্য করেন।
জব্বারের স্মৃতিবিজড়িত এ গ্রামে রয়েছে একটি শহীদ মিনার, ভাষাশহীদের নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। স্থানীয় লোকেরা বলেন, প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে উপজেলার মানুষ। প্রভাতফেরিতে অংশ নেয় গফরগাঁওয়ের মানুষ। পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি খোলা থাকে বছরজুড়েই।
গ্রামের ৬৭ বছর বয়সী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় জানতাম না, ভাষা আন্দোলন কী আর আমাদের গ্রামের মানুষ আবদুল জব্বারের কী অবদান। তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা জানেন। এখন বাইরে থেকেও প্রতিদিন ছেলেমেয়েরা জব্বার নগর গ্রামে আসেন। তাঁরা পাঠাগারে বই পড়েন। কেউ কেউ স্মৃতি জাদুঘরটি দেখতে আসেন। জব্বার আমাদের গ্রামের গর্ব।’
এলাকার তরুণ তোফাজ্জল হোসেনের দাবি, জব্বার নগরে ভাষাশহীদের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হোক এখানে।
মূলত ২০০২ সাল থেকে ভাষাশহীদের এ গ্রামে ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা শুরু হয়। গফরগাঁওয়ের সংস্কৃতিকর্মী ও সাংবাদিক আতাউর রহমান বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা কয়েকজন ২০০২ সালে প্রথম ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের পাঁচুয়া গ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি। তখন শহীদ মিনার ছিল না। কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে দিনটি পালন করি। পরে ২০০৬ সালে গফরগাঁও উপজেলা প্রশাসন সেখানে শহীদ মিনার তৈরি করে। পরের বছর সেখানে জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত হয় ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘর।’
গত রোববার দুপুরে সরেজমিনে জব্বার নগর গ্রামে স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। পুরো জাদুঘরটি সংস্কারে রং করা হচ্ছে। আবদুল জব্বার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তৈরি হচ্ছে মঞ্চ ও প্যান্ডেল। একপাশে ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান তৈরির কাজও চলছে। একুশ ফেব্রুয়ারিতে জব্বার নগরে মেলা হয়। সে মেলায় আশপাশের মানুষেরা আসে।
পাঠাগারের সহগ্রন্থাগারিক কায়সারুজ্জামান বলেন, তিনি ২০১৩ সাল থেকে এ পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের দায়িত্বে আছেন। বর্তমানে পাঠাগারে ৪ হাজার ১৩১টি বই রয়েছে। পাঠাগারে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন পাঠক আসেন। তবে জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বেশি।
যাঁকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই আবদুল জব্বারের পরিবারের কোনো সদস্য জব্বার নগরে নেই। স্থানীয় লোকজন বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আবদুল জব্বার শহীদ হওয়ার আগেই তাঁর পরিবারের সদস্যরা চলে যান হালুয়াঘাট উপজেলায়। দেড় বছর আগে তাঁর একমাত্র ছেলে মারা গেছেন।
ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের স্মৃতি রক্ষার্থে নানা উদ্যোগ থাকলেও কিছু আক্ষেপও রয়েছে এলাকার মানুষের মনে। জব্বার নগর থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে জব্বারের শৈশবের স্কুল ধোপাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহীদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। যখন জব্বার এখানে পড়তেন, এ বিদ্যালয়ের নাম ছিল ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া মহাসড়ক থেকেই জব্বার নগরে যাওয়ার সড়কটির দূরত্ব আনুমানিক তিন কিলোমিটার। এর মধ্যে শেষ এক কিলোমিটার সড়কে পিচঢালাই নেই। শুধু ইটের সোলিং করা। গ্রামবাসীর দাবি, দূর থেকে অনেক মানুষ জব্বারের স্মৃতি জাদুঘরটি দেখতে আসেন। দর্শনার্থীদের কথা বিবেচনা করে সড়কটি পিচঢালাই করা হোক।
গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবিদুর রহমান বলেন, ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে নতুন করে কোনো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা ভাষা গবেষণাকেন্দ্র করা যায় কি না, সেটি বিবেচনার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে তাঁরা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আর ধোপাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ জব্বারের কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকার বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে জানান।