পুকুরের ওপর নির্মিত পূজামণ্ডপ ‘বলছে’ পৌরাণিক কাহিনি, ‘মেট্রোরেলে ছুটছেন’ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা
পুকুরে পানির ওপর মণ্ডপটি তৈরি করা হয়েছে। বাঁশ, কাঠ ও লোহা দিয়ে তৈরি বিশালাকার এই মণ্ডপ প্রদক্ষিণ করতে হাঁটতে হবে ১ হাজার ৪০০ ফুট। মণ্ডপের বিভিন্ন স্থানে পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সরকারের উন্নয়নের চিত্র। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের আলোকদিয়া গ্রামে এমন ব্যতিক্রমী মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে ওই মণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, পূজামণ্ডপে প্রবেশ মুখে গড়ে তোলা হচ্ছে ২০ ফুট উচ্চতার শিবমূর্তি। মণ্ডপে প্রবেশের জন্য নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। কিছু কাজ এখনো চলছে। পূজামণ্ডপ ঘিরে পসরা বসিয়েছেন দোকানিরা। তাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার, খেলনা বিক্রি করা হচ্ছে।
জামালপুর ইউনিয়নের আলোকদিয়া-গ্রাম জামালপুর সর্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির কমিটির উদ্যোগে এই পূজামণ্ডপটি তৈরি করা হয়েছে। এটি জেলার সবচেয়ে বড় মণ্ডপ। এতে প্রবেশের পর দেখা যায়, মেট্রোরেলের আদলে তৈরি করা হয়েছে ‘আনন্দ নিকেতন এক্সপ্রেস’। শ্রীধাম টু অনন্ত লোক। এতে ‘ভ্রমণ’ করছেন উপমহাদেশের ২০ জন সনাতন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী চৈতন্য দেব, শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীসহ অনেকে। ট্রেন দেখার পর মণ্ডপের দর্শনার্থীরা পদ্মা সেতুর আদলে তৈরি সেতু পার হন। এটির নিচে রয়েছে পানির ফোয়ারা।
সেতু পার হলে দেখা যায় সতী ও মহাদেবের পৌরাণিক কাহিনি। তাতে প্রতিমার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেবী সতীর সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবের বিবাহ, কৈলাস গমন, দেবীর দেহত্যাগ ইত্যাদি অধ্যায়। এরপর রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের কুঞ্জবন। সেখানে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া মা অন্নপূর্ণা, কামাখ্যা দেবী ও মহাদেবের সংক্ষিপ্ত পৌরাণিক কাহিনি দেখানো হয়েছে। সবশেষে স্থায়ী মন্দিরে প্রবেশ। সেখানে পূজার মাধ্যমে ভক্তদের দর্শন শেষ হয়।
মণ্ডপে আসা দর্শনার্থীদের কয়েকজন জানান, দেশের বৃহত্তম পূজা মণ্ডপগুলোর মধ্যে এটি সৌন্দর্যের দিক থেকে ব্যতিক্রম। আগের বার বাঁশ ও কাঠ দিয়ে চারতলা ভবনের সমান উঁচু মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। দেশের বাইরে থেকেই ভক্তরা এখানে এসেছিলেন। শুধু সনাতন ধর্মের নয়, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও ভিড় জমান এই মণ্ডপে।
রাজবাড়ী শহরের বিনোদপুর থেকে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে পূজামণ্ডপে এসেছিলেন অসীম কুমার সাহা। তিনি বলেন, এখানে অত্যন্ত চমৎকারভাবে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। দেখে খুব ভালো লাগে। এবার এখনো তেমন ভিড় না বাড়ায় ধীরে সবকিছু দেখতে পারছেন, ছবি তুলতে পারছেন বলে তিনি জানান।
রাজবাড়ীর আইনজীবী অভিজিৎ কুমার সোম বলেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই ধরনের পূজার আয়োজন বিরল ঘটনা। পূজা দেখতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত হন এখানে। মণ্ডপের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন অন্য ধর্মের মানুষেরা। তাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে এই নিরাপত্তা দিচ্ছেন। এটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের একটি উদাহরণ।
মণ্ডপটির জন্য প্রায় তিন শতাধিক প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমার কারিগর সুজিত কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ শুরু হয়ে ছিল প্রায় তিন মাস আগে। প্রতিমার মূল অবকাঠামোগত কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ।’
বাঁশ ও কাঠ ও লোহা দিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারিগর ইউসুফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে পুকুরের ওপর। কাজের সুবিধার্থে পুকুর থেকে পানি কিছু সরিয়ে নেওয়া হয়।’
বৈচিত্র্যময় এই পূজামণ্ডপ তৈরি হয়েছে আলোকদিয়া-গ্রাম জামালপুর সর্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাসের উদ্যোগে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে বড় আকারে পূজার আয়োজন বন্ধ ছিল। আমরা এখানে প্রতিবছর চেষ্টা করি ভিন্নধর্মী কোনো আয়োজন করতে। বিভিন্ন ধরনের পৌরাণিক কাহিনি তুলে ধরতে। পাশাপাশি দর্শনার্থীরা মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু তথা সরকারের উন্নয়ন সম্পর্কেও এখানে জানতে জানতে পারছে। একই সঙ্গে ২০ জন মহামানব সম্পর্কে তারা জানতে পারছে। এখানে বৃহত্তর ফরিদপুর ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে দর্শক-ভক্তরা উপস্থিত হন।’
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান বলেন, জেলার পাঁচটি উপজেলায় এবার ৪৪১টি পূজামণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। তবে আলোকদিয়ার আয়োজনটি ব্যতিক্রম। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ওই মন্দিরে যাওয়া হয়। ইতিমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। পুরো জেলায় সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।