গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ না করা ও শামসুজ্জামানের মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে প্রতিবাদ
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও সাভারে কর্মরত নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা প্রত্যাহার চেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, মিছিল ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
রোববার পালন করা এসব কর্মসূচি থেকে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।
২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের এক প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘ফটোকার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ছবি ছিল একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতিটি নজরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি সংশোধনী দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে প্রতিবেদনটি আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর। বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।
এ নিয়ে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা হয়। বুধবার ভোররাতে তাঁর সাভারের বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।
শামসুজ্জামানকে ৩০ ঘণ্টা পর আদালতে তোলা হয়। এরপর রমনা থানার মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠান আদালত। একই মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন পেয়েছেন। আজ বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা যাবে না’
মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার ও বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে কালো আইন বাতিল করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা যাবে না।
আজ বেলা ১১টায় নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে গণমাধ্যমকর্মীদের পাঠচক্র ‘অনুশীলন’–এর উদ্যোগে সমাবেশ ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি এ কথা বলেন।
কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া সবার হাতে ছিল নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। সেখানে রাখা কাপড়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চেয়ে গণস্বাক্ষর নেওয়া হয়।
কর্মসূচিতে আয়োজক সংগঠনের নির্বাহী সমন্বয়ক আফসানা আক্তার সভাপতিত্ব ও ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সৌরভ সিয়াম সঞ্চালনা করেন। রফিউর রাব্বি ছাড়াও এতে বক্তব্য দেন নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ভবানী শংকর রায়, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক তরিকুল সুজন, সুশাসনের জন্য নগারিকের (সুজন) সভাপতি ধীমান সাহা, সিদ্ধিরগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম, প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি মজিবুল হক ও নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা গোলাম রাব্বানী, আজকের পত্রিকার সাংবাদিক সাবিত আল হাসান, প্রথম আলো নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভার সভাপতি মনিকা আক্তার, সাবেক সভাপতি সাব্বির আল ফাহাদ প্রমুখ।
বক্তব্যের ফাঁকে বাক্স্বাধীনতা হরণ নিয়ে ‘চিৎকার’ শিরোনামে প্রতিবাদী নাটিকা উপস্থাপন করেন নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সুমনা আক্তার। এ ছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণসংক্রান্ত নাটিকা পরিবেশন করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সমগীত’–এর শিল্পী অমল আকাশ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মামলা ও গ্রেপ্তার করে সরকার মূলত সাংবাদিকদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করতে চায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। প্রথম আলো শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে দেশ ও মানুষের কথা বলবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে অতীতের মতো কাজ করে যাবে—সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তাঁরা।
‘মানুষের মতামতকে দমন করা হচ্ছে’
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে গাজীপুর জেলা শহরে রাজবাড়ী রোডে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট গাজীপুর মহানগর শাখা।
এ সময় তাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা যোগ দেন। এর আগে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতারা শহরের শিববাড়ী মোড় থেকে একটি মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট গাজীপুর মহানগর শাখার সভাপতি হারুন অর রশিদ এতে সভাপতিত্ব করেন। সংগঠক শিমুল আহমেদের সঞ্চালনায় এ সময় বক্তব্য দেন মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা, সাবেক আহ্বায়ক মাধব চন্দ্র মণ্ডল ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাহাত আহমেদ, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চের সংগঠক সাদিয়া ইসলাম, প্রসেনজিৎ ঘোষ প্রমুখ। এতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন গাজীপুর জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য একরামুল হক।
মানববন্ধনে নেতারা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে মানুষের মতামতকে দমন করা হচ্ছে। দ্রুত এই কালো আইন বাতিল করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেরও জোর দাবি জানান তাঁরা।
‘সাংবাদিকেরা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে’
বেলা সোয়া ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত শহরের কুষ্টিয়া শহরের এনএস সড়কে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন ‘কুষ্টিয়ার সর্বস্তরের সাংবাদিকেরা’।
বাংলাভিশনের জেলা প্রতিনিধি হাসান আলীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি আল মামুন।
বক্তব্য দেন কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি আনিসুজ্জামান, প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি আবু মনি জুবায়েদ, প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ ও বাংলা টিভির জেলা প্রতিনিধি লিটন উজ জামান, একুশে টিভির জেলা প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদী হাসান, সমকালের জেলা প্রতিনিধি সাজ্জাদ রানা, নিউজ ২৪–এর প্রতিনিধি জাহিদুজ্জামান, কুষ্টিয়া অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি নাজমুল হাসান, জিলাইভ টোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক মুন্সী শাহীন আহমেদ প্রমুখ।
মানববন্ধনে একাত্মতা প্রকাশ করে অংশ নেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কারশেদ আলম।
বক্তারা বলেন, যখনই কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হয়, সেটা পক্ষে না গেলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শায়েস্তা করা হয়। এই আইন দিয়ে সাংবাদিকদের চাপে রাখা হচ্ছে। এ কারণে এখন সাংবাদিকেরা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এ কালো আইন বাতিল করতে হবে।
একই স্থানে একই সময়ে প্রথম আলো কুষ্টিয়া বন্ধুসভা মানববন্ধন করে। এতে বন্ধুসভার সদস্যরা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করো’, ‘সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করো’, ‘সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে মামলা বাতিল করে নিঃশর্ত মুক্তি দাও’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন।
‘সাংবাদিকদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে’
যশোর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সড়কে জেলা প্রেসক্লাবের সামনে আজ দুপুরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ জেলা শাখা। এতে বক্তারা বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনে মামলা দিয়ে ও তাঁদের গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হচ্ছে। এ আইন বাতিল করতে হবে।
এ সময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা নাজিম উদ্দীন, অধ্যাপক ইসরারুল হক ও জিল্লুর রহমান, জেলা কমিটির সম্পাদক তসলিম-উর রহমান, যশোর প্রেসক্লাবের দপ্তর সম্পাদক তৌহিদ জামান, ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সদস্যসচিব চৈতন্য পাল, যুবনেতা আহাদ আলী প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পলাশ বিশ্বাস।
‘গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে’
সাতক্ষীরা শহরের শহীদ আবদুর রাজ্জাক পার্কে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে আজ সকালে সাংবাদিক ও সুধী সমাজের ব্যানারে মানববন্ধন হয়েছে।
সাতক্ষীরার দৈনিক মশালের সম্পাদক আশেক-ই-এলাহির সভাপতিত্বে ও সাংবাদিক বেলাল হোসেনের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ আহমেদ, জেলা জাসদের সভাপতি ওবায়দুস সুলতান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সাতক্ষীরা শাখার সভাপতি আবুল হোসেন, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী, জেলা বাসদের সমন্বয়ক নিত্যানন্দ সরকার, উদীচী সাধারণ সম্পাদক সুরেশ পান্ডে, সাতক্ষীরা বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক ইমরুল হাসান, সাতক্ষীরা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ও সাতক্ষীরায় কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জি।
কর্মসূচিতে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব, সমন্বিত সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশন, জেলা উদীচী, ল স্টুডেন্টস ফোরাম, নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, জেলা জাসদ, জেলা বাসদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ ও প্রথম আলো বন্ধুসভা সংহতি প্রকাশ করে।
বক্তারা বলেন, সাংবাদিকেরা দেশের সাধারণ মানুষের কথা পত্রিকা ও টেলিভিশনে তুলে ধরেন—এতে অপরাধ কোথায়? এ জন্য সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করতে হবে? পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে হবে? এসব কণ্ঠরোধের শামিল। গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানান তাঁরা।
‘দমন করা হচ্ছে জনগণের প্রতিবাদের ভাষা’
সাংবাদিক শামসুজ্জামানের মুক্তিসহ তিন দফা দাবিতে আজ গাইবান্ধা শহরে মিছিল ও সমাবেশ করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট গাইবান্ধা জেলা শাখা। দুপুরে শহরের ডিবি রোডের ট্রাফিক মোড় থেকে মিছিল বের করে সংগঠনটি।
মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট জেলা শাখার সমন্বয়ক মৈত্রেয় হাসান। বক্তব্য দেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জেলা শাখার সভাপতি পরমানন্দ দাস, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি তাহমীদ চৌধুরী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সংগঠক শামীম আরা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, দেশের জনগণ তাঁর ক্ষুধার কথাও প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না। নিপীড়নের মাধ্যমে দমন করা হচ্ছে জনগণের প্রতিবাদের ভাষা। যার বাস্তব প্রমাণ প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান, সম্পাদক মতিউর রহমানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা; যশোর অফিস; প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, গাইবান্ধা]