ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, আমরণ অনশনের ডাক দিয়েছেন খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা
খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এবার আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার মধ্যে তাঁদের তিন দফা দাবি মেনে না নেওয়া হলে ওই সময়ের পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করবেন তাঁরা। ওই কর্মসূচি চলাকালে হাসপাতালের সব ধরনের চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ারও ঘোষণা দেন তাঁরা।
আজ বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ চলাকালে শিক্ষার্থীরা ওই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময় তাঁরা চলমান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এর আগে গত সোমবার রাতে সংঘর্ষের পর তিন দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন ওই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে ৩৬ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন তাঁরা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাবি মেনে না নেওয়ায় আজ সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ এবং হাসপাতালের পরিচালক ও উপপরিচালকের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিনভর বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে হাসপাতাল গেটের সামনে অবস্থিত ওষুধ ব্যবসায়ীরাও দোকান বন্ধ রেখে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। তাঁরাও ব্যবসায়ীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করেছেন।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা করার জন্য লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তখন ওই অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি সোনাডাঙ্গা থানা। কাউকে আটকও করা হয়নি। এ কারণে কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন।
শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি ছিল, ১৬ আগস্ট সকাল ১০টার মধ্যে হামলার সঙ্গে জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করা, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের মাল্টিপারপাস ভবনে কমপক্ষে দুটি মডেল ফার্মাসি স্থাপন এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের কাছে যান খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম ও উপপরিচালক নিয়াজ মুস্তাফী চৌধুরী। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুহাস রঞ্জন হালদার ও অন্য চিকিৎসকেরা। রবিউল ইসলাম শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই মুহূর্তে দুটি মডেল ফার্মেসি স্থাপন করার মতো জায়গা নেই। তবে একটি ফার্মেসি স্থাপন করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হবে।’
দাবি মেনে নেওয়ায় খুশি হন শিক্ষার্থীরা। তবে হামলাকারী ওষুধ ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ যেন ওই ফার্মেসির দায়িত্ব না পান, সে ব্যাপারে পরিচালককে সতর্ক করেন তাঁরা। পাশাপাশি অন্য দাবিগুলো পূরণ না হওয়ায় বিক্ষোভ চালিয়ে যান।
সোমবার রাত নয়টার দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের একটি দোকানে ওষুধ কেনাকে নিয়ে ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওই কলেজশিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থী ও ৯ ওষুধ ব্যবসায়ী আহত হন। এর মধ্যে তিন শিক্ষার্থীর অবস্থা ছিল গুরুতর।
ওই সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, হাসপাতালের সামনের বিপ্লব মেডিসিন কর্নার নামের একটি দোকানে ওষুধ কিনতে যান প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী। কিন্তু ওই দোকান থেকে ওষুধটির দ্বিগুণ দাম চাওয়া হয়। এটা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীকে মারধর করেন দোকানের কর্মচারীরা। পরে ওই শিক্ষার্থী হোস্টেলে এসে অন্যদের ব্যাপারটি জানান। কয়েকজন শিক্ষার্থী কেন ওই শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়েছে, তা জানতে দোকানে গেলে অন্য ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপক মারধর করেন। এতে বিভিন্ন বর্ষের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলেও ২৯ ব্যাচের আনান, ৩১ ব্যাচের মাহাদি ও দেব চৌধুরীর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। তাঁদের মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে। তবে তাঁরা এখন শঙ্কামুক্ত।
অন্যদিকে ওষুধ ব্যবসায়ীদের দাবি, ওই শিক্ষার্থী ৭০ টাকার ওষুধ কেনার পর মোট দামের ওপর ১০ শতাংশ কমিশন চেয়েছিলেন। তবে দোকানদার ওই কমিশন দিতে রাজি না হওয়ায় দুজন বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এতে মেডিকেল কলেজের হল থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ওই দোকানে ভাঙচুর চালান। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই ঘটনায় ৯ জন ওষুধ ব্যবসায়ী আহত হন।
ওই ঘটনায় গতকাল রাতে মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে সোনাডাঙ্গা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। তবে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। ব্যবসায়ীরা চাইছেন সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করতে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের ওপর হামলা করলেও তাঁরা পাল্টা কোনো কর্মসূচি দিতে চান না। তাঁরা চান ব্যাপারটি যেন সহজে মীমাংসা হয়ে যায়। এ কারণে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দোকান বন্ধ রেখে তাঁরা কোনো ধর্মঘট পালন করছেন না। তাঁরা আশঙ্কা করছেন দোকান খুললে শিক্ষার্থীরা আবারও হামলা করতে পারেন। ওই এলাকায় ৯০টি ওষুধের দোকান রয়েছে।
ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির কেন্দ্রীয় পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, প্রশাসন থেকে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হলে খুলনা জেলার সব ওষুধের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপরও হয়রানি করা হলে খুলনা বিভাগের সব ওষুধের দোকান বন্ধ করা হবে।
আজ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মুঠোফোনে জানতে চাইলে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া চলছে। ব্যবসায়ীদেরও কয়েকজন আহত রয়েছেন। তাঁরাও মামলা করবেন বলে শুনেছি। ব্যবসায়ীরাও যদি মামলা করেন, সেটিও গ্রহণ করা হবে। মামলা হওয়ার পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।’
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওই কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে কর্মবিরতি শুরু করেন ওই হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ওই কর্মবিরতি চলবে বলে জানান তাঁরা।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রেখেছেন। শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কর্মবিরতি পালন করবেন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুহাস রঞ্জন হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কাজে ফেরেননি। তবে চিকিৎসায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অধিকাংশ ওষুধ হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই রোগীদের ভোগান্তিও কম। হয়তো অল্প কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। হাসপাতালের সামনের দোকান বন্ধ থাকলেও আশপাশের বয়রা বা সোনাডাঙ্গা এলাকার সব ওষুধের দোকান খোলা রয়েছে।