ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিদের ছোড়া গুলিতে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিমের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। সোমবার বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে স্মরণ করেন মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ।
রবিউল করিমের বাড়ি মানিকগঞ্জ সদরের কাটিগ্রাম গ্রামে। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার তাঁর জন্মস্থানে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে দেশি ও বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে জঙ্গিরা। খবর পেয়ে তাঁদের উদ্ধারে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম। এ সময় জঙ্গিদের ছোড়া গুলি ও গ্রেনেডের আঘাতে তিনি নিহত হন। একই ঘটনায় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহউদ্দিনও নিহত হন।
সোমবার সকাল ১০টার দিকে রবিউলের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নজরুলবিদ্যা সিঁড়ি প্রাঙ্গণ থেকে একটি শোকযাত্রা বের হয়। শোকযাত্রাটি প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে কাটিগ্রাম কবরস্থানের সামনে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে রবিউলের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক) শিশু-কিশোরদের জন্য রবিউলের গড়া বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি (ব্লুমস) বিশেষায়িত বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল হয়। এতে ব্লুমসের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম সঞ্চালনা করেন।
বক্তব্য দেন স্থানীয় কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিপ্লব হোসেন, ব্লুমস পরিচালনা কমিটির সভাপতি জিআর শওকত আলী, কার্যনির্বাহী কমিটির সহসভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ইকবাল হোসেন, সদস্যসচিব প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক ও রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস, রবিউল করিমের সহধর্মিণী উম্মে সালমা প্রমুখ।
বিপ্লব হোসেন বলেন, ‘রবিউলের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। তাঁর কাজগুলো আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা জোগায়। আমরা একসঙ্গে ব্লুমস শুরুর সময় কাজ করেছি। তখন দেখেছি, মানুষের প্রতি তাঁর মমত্ববোধের জায়গা কতটা প্রকট। আমার সক্ষমতা খুবই সীমিত। এরপরও ব্লুমসকে টিকিয়ে রাখতে আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে যাব। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে কথাও বলেছি। সবাই মিলে ব্লুমসের জন্য কাজ করলে ও প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই রবিউলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।’
শামসুজ্জামান শামস বলেন, ‘রবিউল ভাই গ্রামের অবহেলিত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য ব্লুমস প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। পাশাপাশি সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুদের জন্য নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি নামের অপর একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি খুব অল্প সময়ে তাঁর সামর্থ্য অনুসারে এসব করেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এখন আমাদের সবার। সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।’
শওকত আলী বলেন, ব্লুমস পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিকসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। রবিউল থাকলে হয়তো এটা নিয়ে ভাবতে হতো না। রবিউলের স্বপ্নে গড়া প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। রবিউল সবাইকে দেখিয়েছেন, কীভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, মানুষের সেবা করতে হয়।
পরিবারের লোকজন বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ছিল রবিউলের বাবা আবদুল মালেকের। ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর রবিউল সে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা চালান। রবিউলের মা করিমন নেছা ২৯ শতক জমি দান করলেন। ২০১১ সালে বাড়ির অদূরে বাসাই গ্রামে সেই জমিতে গড়ে ওঠে ব্লুমস। ২০১২ সালে ১২টি অটিস্টিক শিশু-কিশোরকে নিয়ে বিদ্যালয়টি কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিমধ্যে এই বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরদের অনেকে এখন মূলধারায় ফিরেছে।
বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৪৬ জন শিশু-কিশোর পড়াশোনা ও চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। বিশেষায়িত বিদ্যালয়টিতে সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঠদান করানো হয়। শিশু-কিশোরদের ফিজিওথেরাপি ও স্পিচ থেরাপি দেওয়ার পাশাপাশি ইশারা ভাষা শেখানো হয়। আছে খেলাধুলার ব্যবস্থাও।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, প্রায় সাত বছর ধরে বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরদের জন্য দুপুরের খাবার (ডে-মিল) দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যাটারিচালিত দুটি ইজিবাইকে করে শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করা হয়। পোশাক থেকে শুরু করে স্কুলব্যাগ, বই, খাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিবছর মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
এদিকে, বেলা ৩টার দিকে মানিকগঞ্জের পুলিশ লাইনসে রবিউল করিম ফটকের পাশে নির্মিত রবিউল করিমের ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রবিউলের পরিবারের সদস্যরা।