কারাগারে নির্যাতনের শিকার নারী বললেন, পাপিয়ার হাত–পায়ে ধরেও রক্ষা পাইনি
‘আমার কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। সেই টাকা কেড়ে নেওয়ার জন্য কারাগারের হাজতি যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়াসহ তার সহযোগীরা সিসি ক্যামেরা নেই এমন স্থানে নিয়ে যায়। টাকা চাইলে দিতে অস্বীকার করলে তারা জোর করে সেই টাকা নিয়ে যায়। পরে পাপিয়া ও তার সহযোগীরা শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে অমানবিকভাবে আমাকে মারধর করে। আমাকে না মারার জন্য পাপিয়ার হাত–পায়ে ধরেছি। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। আরও বেশি করে আমারে মেরেছে।’
এভাবেই নির্যাতনের বর্ণনা দেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারের সাবেক বন্দী রুনা লায়লা। সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। নির্যাতনের অভিযোগে তাঁর ভাই গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
রুনা লায়লা গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার কড়িহাতা গ্রামের আবদুল হাইয়ের মেয়ে এবং এ কে এম মাহমুদুল হকের স্ত্রী। তিনি ঢাকার কোতোয়ালি থানার ৭৩৫ নম্বর মামলার আসামি। গত ১৬ জুন থেকে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। ২৭ জুন তিনি জামিনে মুক্তি পান।
রুনা লায়লা বলেন, ‘আমি উকিল জানার পরে একজন কিছু টাকা দেয়, কিন্তু সেটি পিসিতে জমা দিতে হবে এটা তারা বুঝতে পারেনি। সেই টাকা নেওয়ার জন্য তারা মারধর করে এবং কম্বল চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। পাপিয়া নিজেও মেরেছে, তার সহযোগী (জেলহাজতের আসামিদের) দিয়েও মারধর করিয়েছে।’
আজ সোমবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন রুনা লায়লা। তিনি তাঁর পা থেকে জামা সরিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখান। পুরো পা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতে কালো হয়ে আছে। শরীরের ব্যথায় এক পাশ থেকে অন্য পাশে কাত হতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের কাছে পানি চাইলে ময়লা পানি দেয় খেতে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে পাপিয়া ভয় দেখায় বলে, কাউকে বললে আবারও জেলে আসতে হবে। তখন আরও নির্যাতন করব। আমার জামিন হয়ে যেত, তোর কারণে আমি আবার ঝামেলায় পড়লাম।’
রুনা লায়লার ছোট ভাই আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বোন মানসিকভাবেও অসুস্থ। নির্যাতনের কথা মনে করে প্রায় ভয়ে আঁতকে ওঠেন। আবোলতাবোল বলা শুরু করেন। তাঁকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমার বোনের সারা শরীরে কালো দাগ হয়ে আছে। এগুলো সবই আঘাতের চিহ্ন। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে হাসপাতালে দেখতেও এসেছিল।’
মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেল সুপার ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু কারাগারে ঘটনাটি ঘটেছে, তাই মানবিক কারণে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। তাঁর বর্তমানে অবস্থারও খোঁজখবর নিয়েছি।’
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, নথি চুরির একটি মামলায় শিক্ষানবিশ আইনজীবী রুনা লায়লাকে ১৬ জুন কাশিমপুর মহিলা কারাগারে আনা হয়। কারাগারের সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়ার পর রুনার দেহ তল্লাশি করে কর্তব্যরত মেট্রন তাঁর কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা পান। ওই টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য পাপিয়া ও তাঁর সহযোগীরা ১৯ জুন রুনাকে নির্যাতন শুরু করেন বলে অভিযোগ তাঁর পরিবারের। একপর্যায়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রুনাকে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। এ নিয়ে কারাগারের ভেতরে কেস টেবিল বা সালিস বসে। সেখানে ত্রিমুখী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বন্দী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। তবে পাপিয়ার ভয়ে সাধারণ কয়েদিরা রুনা লায়লার ওপর অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিবাদও করতে পারেননি।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাঁর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চলছে।
কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের (ভারপ্রাপ্ত) জেল সুপার মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া কারাগারের ভেতরে এমন ঘটনা যাতে আর না হয়, সে বিষয়েও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।